মা

মা
মা দিবসের শুভেচ্ছা

Sunday, May 11, 2014

মা কে চিরবিদায় দেওয়ার দিনের ঝাপসা স্মৃতি



যাদের মা অনেক দূরে তারা যেমন তাদের মাকে মিস করে আমিও তেমনি খুব মিস করি আমার মাকে। কিন্তু তাদের এবং আমার মিস করার মধ্যে কোন মিল নেই। কারন, অনেকে হয়তো মায়ের কাছ থেকে সাময়িকভাবে দূরে আছে, হয়তো আবার ফিরে যাবেন মায়ের কোলে। কিন্তু আমার যে আর সেই সুযোগ নেই। আমি আমার সেই সাডে ছয় বছর বয়সে আমার প্রাণপ্রিয় মাকে চিরবিদায় দিয়েছি।
আমার ঠিক স্পষ্ট মনে নেই সেদিনকার কথা। ২০০৩ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর, আমার মা ছিলেন আমার নানার বাডিতে। সেখানেই আমার শেষ ভাইয়ের জন্ম হয়েছিল। বাডিতে ছিলাম আমি আর আমার বাবা। আমার বাবা প্রতিদিন চলে যেতেন হাই স্কুলে (তিনি সেখানকার শিক্ষক), যাবার পথে আমাকে আমার কেজি স্কুলে পৌছে দিতেন (তখন আমি নার্সারীতে পডি)।
২৯ তারিখও প্রতিদিনের মত স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাবার সাথে স্কুলে যাবার জন্য বের হয়েছিলাম। হঠাত্করে একটা মোটরসাইকেলে করে আমার মেজ মামা এবং আরেকজন লোক তাডাতাডি করে আমার বাডিতে আসল এবং আমার বাবাকে কি যেন বলল (আসলে তারা সেদিন আমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ দিতে এসেছিল)। তারপর আমার মামা আমার ব্যাগটা খুলে বাডির ভেতর ছুডে মারল আর বলল 'আজকে স্কুলে যেতে হবে না'। আমি তখন দারুণ খুশি হয়েছিলাম (তখনো আমি বুঝতে পারিনি আমার মা মারা গেছেন)।
তারপর আমার বাবা আমাকে পুকুরপাডে অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি আসার আগ পর্যন্ত আমি সেখানে অপেক্ষা করার সময় পাশের বাডির একটা মেয়ে বলল 'তোর মা মারা গেছে'। আমি প্রথমে ভাবলাম সে আমার সাথে ঠাট্টা করছে, কিন্তু পরে তার সিরিয়াস কন্ডিশন এবং আমার বাবার অবস্থা দেখে চিন্তা করলাম হতেও পারে।
আমার বাবা একটা বেবীট্যাক্সি নিলেন এবং বললেন 'চুনতি' যাবেন, তখন আমি আরো নিশ্চিত হলাম ('চুনতি' ইউনিয়নে আমার নানার বাডি)।
আমি স্কুলের ড্রেস পডা অবস্থায় গাডিতে ওঠে পডেছিলাম।
গাডিতে ওঠার পর দেখলাম আমার বাবা খুব কাঁদছেন আর ড্রাইভারকে তাডাতাডি গাডি চালাতে বলছেন (আমার বাডি থেকে নানার বাডির দুরত্ব প্রায় ছয় মাইল)।
সম্ভবত সকাল আটটার দিকে আমরা সেখানে পৌছেছিলাম। সেখানে পৌছার সাথে সাথে বেশ কয়েকজন আমাকে বারবার কোলে নিতে থাকল এবং তারা আমাকে জডিয়ে ধরে কাঁদছিল। পুরো বাডিতে লোকে গিজগিজ করছিল।
ভেতরে যাওয়ার পর আমার ভাই সজীব'কে দেখলাম, সে আমার মায়ের সাথেই নানার বাডীতে এসেছিল (সজীব আমার ছোট ভাই, তখন তার বয়স ছিল দুই বছর)। একজন আমাকে বলল আমার তৃতীয় আরেকটা ভাই হয়েছে।
আমার মামা আমাকে কোলে নিয়ে গিয়ে আমার মা কে দেখাল। দেখলাম মা শুয়ে আছেন এবং চারপাশের লোকজন তার দিকে তাকিয়ে কাঁদছেন। কয়েকজন আমাকে বলল 'তোর একটা ছোট ভাই হয়েছে তো তাই তোর মা ঘুমিয়ে আছেন'। এই কথাটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি....
পরে যখন বুঝতে পারলাম মা মারা গেছেন তখন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
সবাই বলাবলি করছিল 'ডেলিভারীর সময় মারা গেছেন'। সে সময় আমি এই কথাটির মানে বুঝতেই পারিনি।
অনেক্ষন পর দেখলাম আমার মাকে খাটিয়ায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানতে পারলাম তাকে কবর দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি তখন ছোট থাকায় আমাকে নেওয়া হয়নি। তারপর আমি আর আমার বাবা ওই দিন জন্ম নেওয়া ভাইটাকে নিয়ে চলে এসেছিলাম। দুই বছর বয়সী যেই ভাই টা আমার
মায়ের সাথে নানার বাডিতে গিয়েছিল, সে ওখানেই ছিল।
এর অনেক বছর পরে আমি জানতে পারি যে আমার সর্বকনিষ্ঠ ভাইয়ের জন্ম দেওয়ার সময় তিনি মারা গেছেন।
সন্তানের জন্য একজন মা কতবড সেক্রিফাইজ করতে পারেন তার জলন্ত উদাহরণ আমার 'মা'
আমি এবং আমার দুই ভাই গত বারোটি বছর কাটিয়েছি মাতৃহীন অবস্থায়। হয়তো ভবিষ্যতের দিনগুলোও এভাবেই কাটবে।
এখন সারাজীবন মাকে শুধু মিস করেই যাবো কিন্তু কোনদিন মাকে ফিরে পাবো না।
একটা বড রকমের আফসোস হয় আমার মায়ের কবর আমার নানার বাডীতে, তাই নিয়মিত কবর জিয়ারত করতে পারি না। তারপরেও আমি নামাযের পর সবসময় মায়ের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করি। আপনারাও আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন।

আমার মা ---
নামঃ মোবরেকা খানম সিদ্দিকা (রেখা)
জন্মঃ ৩০ জুন ১৯৭০
মৃত্যুঃ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৩


লিখেছেন- শাহরিয়ার 

No comments :

Post a Comment