মা

মা
মা দিবসের শুভেচ্ছা

Thursday, May 15, 2014

মায়ের জন্য যতো কিছু

আমি জহির । বাংলাদেশের স্বনামধন্য এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে আছি লেকচারার হিসেবে। আমার জীবনটা নিয়ে আমি অনেক স্বন্তুষ্ট। আমি আজ অনেক ভালো অবস্থায়। কিন্তু এখানে আসতে আমাকে যতটা না কষ্ট করতে হয়েছে তার চেয়ে হাজার গূন বেশি কষ্ট আমার মা করেছেন।

আজ থেকে আঠাশ বছর আগের কথা। রেহানা বেগমের কোল আলো করে আসে ছোট্ট ছেলে। ফুটফুটে ছেলে। অল্পশিক্ষিত মা জহির রায়হানের খুব ভক্ত ছিলেন। তাই ছেলের নাম দেয় জহির রায়হান। ছেলেটাকে পাশে শুইয়ে দিয়ে মা চিন্তায় পড়ে যান খুব।ছেলের জন্মদাতা যে এখনো বাংলা মদের দোকানে ফুর্তিতে আছে।

রেহানা বেগম ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করেন। নেশাগ্রস্থ পিতার সহচর্যে যেয়ে এই হিরার টুকরা ছেলেকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেয়া হবে। হলো ও তাই। নেশার জন্য বাবা ছেলেকে বিক্রির কথাও তুলে। আমার মা এসব শুনে সাথে সাথেই তার বাবার বাড়ি চলে যান আমাকে কোলে নিয়ে। ভেবেছিলেন হয়তো বা মাথা গোজার ঠাই হবে সেখানে।

তিন ভাই এর সংসারে আমার মা একমাত্র বোন। ছোট মামা ও বিয়ে করে ফেলেছিল। তিন ভাই এর জন্য তিনটি রুম ছাড়া আমার নানার বাড়িতে আর একটাও অতিরিক্ত রুম ও ছিল না। আর আমার মামিরা প্রায় সব কাজই নাকি আমার মা কে দিয়েই করাতো। আমার মা ও সব কাজ করতো। মামিদের কাপড় ধোয়া,মামাতো ভাই বোনদের খাওয়ার ব্যাবস্থা করা সব কিছু করতো।

কিন্ডারগার্টেন এর ছেলেদের দেখে আমার মা প্রায়ই ভাবতো তার ছেলে এরকম রঙ্গিন ড্রেস পরে স্কুলে যাবে। স্কুল গাড়ি এসে তার বাড়ির সামনে এসে বেল বাজাবে। মাথায় সিথি করে চুল আচড়িয়ে দিয়ে আমার টিফিন বক্স নিয়ে মা আমাকে এগিয়ে দিবে।

কিন্তু না!! আমার ভাগ্যে কিন্ডারগার্টেন জুটেনি। আমার মায়ের ইচ্ছেও পুরণ হয়নি। মায়ের অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ছয় বছর বয়সে আমাকে মাথার উপর হাত দিয়ে অপর পাশের কান ধরে ভর্তি হতে হয়েছে সরকারী স্কুলে। স্কুলের শিক্ষকরা আমার উপবৃত্তির ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রতি ছয় মাসে আমি তিনশো টাকা পেতাম। সেটা দিয়ে আমার খাতা কলম কিনে দিতো মা। ঠিক দুইশো পঁচানব্বই টাকা খরচ করতো মা। বাকি পাচ টাকা দিয়ে মা একটা ব্লাউজ কিনতো নিজের জন্য।

না,এভাবে বসিয়ে রেখে খাওয়াতে একেবারেই সমস্যা হচ্ছিল আমার মামা মামিদের। দুটো উটকো ঝামেলা এসে তাদের ঘাড়ে পড়বে তারা চিন্তাও করেনি কখনো। আমার মা কে বলা হলো পরের মাস থেকে বাড়ি থাকতে হলে খাওয়া থাকা বাবত টাকা দিতে হবে।উপায়ান্তর না পেয়ে আমার মা পাশের বাড়িতে কাজ করে। এক বাড়ির কাজ দিয়ে সংসার চলতো না।এক সময় আমার মা চারটা বাড়িতে বুয়ার কাজ করতো।

আমি এক ক্লাস দুই ক্লাস করে বড় হই। প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠার সময় আমি প্রথম হয়েছিলাম। মজার ব্যাপার হলো,যে ছেলেটি সেকেন্ড হয়েছে তাদের বাড়িতে আমার মা কাজ করতো। এবং টানা দুই ক্লাস আমি ফার্স্ট হবার কারণে আমার মায়ের চাকুরী যায় ও বাড়ি থেকে।

স্কুলের এক শিক্ষক আমার ভালো ফলাফল দেখে উনি আমাকে বিশ টাকা দিয়েছিলেন। সেদিন আমার খুব খুশি লেগেছিল। আমার মায়ের ছেড়া শাড়ি সেলাই করতে তিন টাকা, একটা সাবান কিনি সাত টাকায় আর বারো টাকা মা কে দিয়ে আসি।

আমার মা হণ্যে হয়ে খুঁজছিলেন একটা চাকরী। বুয়ার চাকরী। মা পেয়েও যায়। নিজের বাবার বাড়িতেই। আমার মেঝ মামার ঘরের সব কাজ করে দেন তিনি। আমার মামি আমার মা কে আর নাম ধরে ডাকেনা। 'বুয়া' বলে ডাকতো। একদিন আমি আমার মা কে জিগেস করি, 'মা, বুয়া মানে কি?' আমার মা হেসে উত্তর দেয়, 'বাবা, বুয়া মানে হলো যাদের তোর মতো একটা লক্ষী ছেলে আছে '।

কিন্তু না। আমি বুঝে যাই এটার মানেটা আমার মা আমাকে লুকিয়েছে। স্কুলে একটা ছেলের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিল। সে আমাকে বলেছিল,'তুই তো বুয়ার ছেলে '। আমি তাকে বললাম,'পারলে বুয়ার ছেলে হয়ে দেখা, আমার মা বলেছে যাদের আমার মতো একটা ভাল ছেলে আছে তাদের কে বুয়া বলা হয়।' ব্যাস মুহুর্তেই হাসির রোল পড়ে গেলো চারিদিকে। মা কে এসে কিচ্ছু বলিনি। শুধু জেনেছি এই শব্দটা খারাপ। শুধু বুঝেছি এটা আবার জিগেস করলে মা হয়তো রাগ করবে।

আমি প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে হাই স্কুলে উঠি। প্রাইমারি স্কুলে আমার বই ফ্রি তে দিতো সরকার। কিন্তু হাই স্কুলের বই নাকি কিনতে হয়।আমার মা আমার মামাকে বলেছিল। মামা আবেগী হয়ে পকেটে হাত দেয়ার সময়ই মামি এসে মামাকে টেনে রূমে নিয়ে যায়। ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয়। যেই সব বাড়িতে কাজ করতো তারাও কেউ দেয়নি টাকা। আমার মা গভীর চিন্তায় পড়ে যায়। পরের দিন সারাদিন মাকে আর দেখিনা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমার মা রাতে এসেছিল।দেখলাম তার হাতে ব্যান্ডেজ। আর হাতের মুঠোয় কিছু টাকা। কিছু বলিনি। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি মা আমার বই কেনার জন্য রক্ত বিক্রি করতো।

আমি পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পাই। সেখানের টাকা দিয়ে আমি নিজ হাতে মায়ের জন্য শাড়ি কিনি। আমার মা সে শাড়ি দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদে। আমি তখনো বুঝিনি মা কেন কাদছে। আশ্চর্যের ব্যাপার মা কে বাবার কথা বলতেই মা আমার উপর রাগ করতো। কখনোই কিছু বলতো না।

আমি অষ্টম শ্রেণী পাশ করার পর সবাই বলেছিল আমি যেন সাইন্স নিই। কিন্তু শুনেছি সাইন্সে নাকি অনেক খরচ। সব বিষয়ের প্রাইভেট পড়তে হয়। তখন আমার টাকা পয়সার বিষয়ে জ্ঞান বুদ্ধি হয়। আমি বুঝতে পারি আমার মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে। আমি তখন বুঝতে শিখেছি বুয়া মানে কি। ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানের প্রতি আমার ঝোক ছিল। বাশের ভেতর ব্যাটারি দিয়ে আমি টর্চ বানিয়ে একবার বিজ্ঞান মেলায় পুরষ্কার ও পাই। কিন্তু আমি সাইন্স নিতে পারিনি। আমি নিয়েছি কমার্স।কোন মতে আমার পড়াশোনা চলছে। ক্লাস নাইনে উঠেছি। এখন নিজের ও খরচ আছে। তাই আমি টিউশানি খুজি। একটা ক্লাস থ্রির ছেলেকে পড়ানো শুরু করি। আমার মা অনেক নিষেধ করেছিল কিন্তু আমি তো জানি হয়তোবা আমার খরচ জোগাড় করার জন্য আমার মা আরেক বাড়িতে কাজ নিবে।

এভাবে দিন যেতে পারতো। কিন্তু আমার তিন মামি কেন জানি আমার পড়ালেখা সহ্য করতে পারতো না। একদিন তো আমার বড় মামি কোন কারণ ছাড়া আমার হিসাববিজ্ঞান বই ছিড়ে ফেলে। সেদিন প্রথম আমার মা প্রতিবাদ করে।
তারপর থেকে আমার ছোট মামির ঘরে আমার মার চাকরী শেষ।

হিসাব বিজ্ঞান বই টা এমন দিনে ছিড়েছে পরের দিন আমার পরীক্ষা ছিল। মা বুঝতে পারে। কিন্তু মা এটা করবে আমি ভাবিনি। এক বাড়িতে ঘর ঝাড়ু দেয়ার সময় ত্রিশ টাকা চুরি করতে গিয়ে ধরা খায় আমার মা। সেদিন সেই বাড়ির চাকরীও যায়।

এবার মা কাথা সেলাই শুরু করে। এক মাসে একটা নকশী কাথা সেলাই করে দিতো মা । পাটি বানাতো। মোড়া বানাতো। এসব নিয়ে আবার হাট বারে বিক্রি করতো। আমার মা কখনো আমাকে বাজারে যেতে দেয়নি। অনেক বলতাম, 'মা তুমি বানাও আমি বিক্রি করবো। ' আমার মা বলতো,'না, এই বয়সে ছেলেরা বাজারে গেলে নষ্ট হয়ে যায়। ' আমিও চুপচাপ থাকতাম।

আমাদের ঘরটা ছিল ছোট্ট। একটা চৌকি আর সুপুরি গাছ দিয়ে বানানো একটা মাচা,যার উপর বই রেখে পড়াশোনা করতাম আমি।

আমার টিউশানির টাকা আর আমার মার কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে দিন চলে যায় আমাদের। কিন্তু বিনা দোষে আমার মামিরা আমার মার উপর অত্যাচার করত মানসিক ভাবে। একদিন মা বলেই দিলো,"এটা আমার বাবার বাড়ি। আমার সম্পত্তি বুঝিয়ে দেন"। তারপর থেকে মামিরা কথা বলতো না আর।

আমার নিজ মামাতো ভাই আমাকে 'বুয়ার ছেলে ' বলে ক্ষ্যাপাতো। একদিন আমি উত্তেজিত হয়ে তাকে থাপ্পড় দিই। সাথে সাথে আমার মামা বের হয়ে আমাকে প্রচন্ড আঘাত দেয়। আমার মা তখন অন্যের বাড়িতে কাজে ছিলেন। নইলে সেদিন অনেক বেশি কিছু হতো।

মেট্রিক পাশ করি আমি। বোর্ড স্ট্যান্ড হই। আমাদের দিন টা তখনই বদলে যায়। তিন চারটা টিউশানি পাই আমি। আমার মা কে বলি উনি যেন আর কারো বাসায় না যান। মাও আমার কথায় রাজী হয়ে অনেক বাড়িতেই কাজ ছেড়ে দেয়। শুধু একটা বাড়িতে কাজ রাখে। এটা নাকি উনার প্রিয় বাড়ি। কিন্তু একি? যার বাড়িতেই পড়াতে যাই সেই বলে,'আমার মা কি তাদের বাড়িতে কাজ করতে পারবে কিনা?' আমার বুক টা ফেটে যায় তখন। ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলি আমার মা বুয়া না।
বাধ্য হয়ে আমি পড়ানো ছেড়ে দিই। আবারো কষ্ট নামে আমাদের সংসারে।

গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে কিছু ছাত্র পাই আমি। প্রতিদিন হেটে হেটে গিয়ে আমি তাদের পড়াতাম। আমার মার একটাই স্বপ্ন তার ছেলে বড় হয়ে দেশের নামকরা একজন হবে। টিভির পর্দায় তাকে দেখবে দেশের লোকজন।

ইন্টার পরীক্ষা আমার মার সেই স্বপ্ন ভেঙে দেয়। অনেক দূরে প্রাইভেট পড়ানোর ফলে আমি অসুস্থ হয়ে যাই। পরীক্ষা দিতে পারিনি সেবার। আমার মা আমাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আর কোন টিউশানি নয়।যত টাকা লাগে আমি দিবো। '

আমার মা আবারো মানুষের বাড়িতে কাজ নেয়। পাটি বানায়। নকশী কাথা সেলাই করে। পুরো এক বছর আমার মা অনেক পরিশ্রম করে। পরের বছর ইন্টার পরীক্ষায় আমি ভালো ফলাফল করি। আশ্চর্য জনক ভাবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আই বি এ তে চান্স পাই।

আমাদের কষ্টের দিন শেষ। হলে উঠে আসি আমি। টানা ছয় মাস প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু টাকা জমিয়ে নিই আমি। এ ছয় মাস আমার মা বাড়িতে ছিল। মামিদের অত্যাচার সহ্য করে আর পাড়ার লোকের বাজে কথা শুনে। আমার মার নাকি ভাব বেড়ে গেছে। এখন আর কারো ঘরে কাজ করেনা। তার ছেলে যে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে!!

আমি মা কে নিয়ে আসি ঢাকাতে। বস্তি টাইপ একটা ঘর ভাড়া করি আমরা মা ছেলে। তখন জানতে পারি আমার বাবার কথা। এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। তাই মা আমাকে সব বলেছে। বাবার খোজে আমি বাড়ি যাই। শুনি আমার বাবা নাকি ড্রাগ কেনার জন্য নিজের কিডনী বিক্রি করেছিল। সেই ড্রাগ হাতে থাকা অবস্থায়ই বাবা মারা যায়।মা কে ঘটনা টা বলতেই আমার মা কেদে দেয়।হাজার হউক স্বামী তো।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় হই। প্রথম তিন জনের মা কে গোল্ড মেডেল দিবে। আমার মা কে আমি নিয়ে যাই। প্রাইভেট পড়িয়ে উপার্জিত টাকা দিয়ে মাকে কিনে দিই নতুন শাড়ি। সংসারে মোটামুটি অভাব নাই এখন।

গোল্ড মেডেল দেয়ার আগে প্রত্যেক মার বক্তব্য শোনানো হয়।আমার মার বক্তব্য শুনে আমাদের ভিসি কেদে দেয় আর প্রধান অতিথী প্রধানমন্ত্রী ও কেদে দিয়েছিলেন। তারা সবাই এতটাই আবেগাক্রান্ত হয়েছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী যাদের কে মেডেল পরিয়ে দেয়ার কথা সেই প্রধানমন্ত্রী আমার মা কে আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের তিন জনকে মেডেল পরিয়ে দেয়ার জন্য।

এরপর গত ছয় মাস আমি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি। লন্ডনের স্কলারশীপ পেয়েছি আমি। মা সহ যাবো তাই একটু দেরী করছি। ঢাকার বারিধারায় আমি একটা ফ্ল্যাট কিনি মায়ের জন্য। তিনটা কাজের লোক রেখেছি মায়ের সেবা করার জন্য। আশ্চর্যের ব্যাপার আমার মা তাদের কে কাজ না করিয়ে গল্প করে তাদের সাথে। মাকে জিগেস করতেই মা বলে,'আমিও তো এক সময় তাদের মতোই ছিলাম বাবা। '

আমি কিচ্ছু বলিনি। আমার মায়ের পরনে এখন আর ছেড়া শাড়ি নেই। নবরূপা থেকে কেনা শাড়ি আমার মায়ের পরনে। মা এখন আর মোটা চালের ভাত খায় না। আমি যে তার জন্য নাজির শাইল কিনি।
আমার মায়ের জন্যই তো এত দুর আসা আমার.....

No comments :

Post a Comment