১।
আমি সাধারণত একেবারে বাধ্য না হলে হাসপাতালে যাই না। এর পেছনে একটা কারণও আছে। সাধারণত হাসপাতালে গেলে ভীত, অসহায় মুখগুলো দেখা যায়, আর্তনাদ আর কান্না ভাসে বাতাসে।মন খারাপ হয়ে যায়।
শেষবার আমার ডাক্তার বন্ধুর সাথে দেখা করতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সে ওয়ার্ডে ছিলো। একটা প্রতিবন্ধী ছেলেকে দেখছিলো, পাশেই ছেলেটির মা বার বার আচল দিয়ে চোখ মুছছিলো। আর বার বার ছেলেটির বুকে হাত রেখে দেখছিলো বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছিলো কিনা। প্রতিবন্ধী ছেলেটি অচেতন হয়ে পরে ছিলো, ছেলেটির মা বার বার ছেলের কপালে হাতে চুমু খাচ্ছিল। চোখের পানিতে ছেলেটির কপাল ভিজে গেছে। ছেলেটির বয়স আঠারো হবে, কিন্তু সে উঠে বসতে পারে না, কথা বলতে পারে না। এই আঠারো বছর ধরে তার মা তাকে ছোট্ট শিশুর মত লালন করেছে। খাইয়েছে, নোংরা পরিষ্কার করেছে, সমাজের গঞ্জনাও সহ্য করেছে। তিনি তার মুখে মা ডাক শুনেননি, প্রথম হাটতে দেখে হাত তালি দেয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি, তার ছেলে স্কুল থেকে ফিরে তার কোলে ঝাপিয়ে পড়েনি, তিনি স্বপ্ন দেখেননি, তাঁর ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে কিংবা চাকরীর প্রথম বেতন দিয়ে শাড়ি কিনে আনবে। তবুও কেনো কোনো স্বপ্ন ছাড়া, কোনো স্বার্থ ছাড়া জীবনের সব শক্তি ব্যয় করে এই ছেলেটিকে বাঁচিয়ে রাখলেন, কেনো তাঁর বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দটি শোনার জন্য চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছেন? সেই রহস্য আমি ভেদ করতে পারিনি কেউ পারবে না। এই রহস্যকেই সম্ভবত মাতৃত্ব বলে।
আমার বন্ধুকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলাম, অবস্থা কেমন। সে শুধু মাথা নাড়ালো। একটু পর ছেলেটির মা আমার ছেলেটির বুকে হাত দিয়েই চমকে উঠলো, বুকটা স্থির হয়ে আছে। তিনি আমার বন্ধুর পায়ে জড়িয়ে ধরলেন। উনুনয় করে বললেন, আমার পোলার বুক থাইম্যা গেছে, কিছু করেন স্যার। তারপর ছেলের মাথাটা নিজের কোলে উঠিয়ে কপালে গালে চুমু খেতে লাগলেন। আদর করে ডাকতে লাগলেন, তারপর আবার বুকে হাত দিলেন। তারপর আর্তনাদ করে উঠলেন, সেই দৃশ্য আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারিনি। তারপর থেকে আমি আর হাসপাতালে যাইনি। মায়েদের আর্তনাদ শোনার ক্ষমতা আমার হয়নি।
২।
আমাদের বাসার সামনে কিছু দোকানপাট আছে, সেখানে প্রায়ই দেখি উষ্কখুষ্ক চুল, ছেড়া ময়লা জামা পরা একটা পাগল মহিলা রাস্তায় বসে নিজে নিজে কথা বলে। আমি যখন রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকি আমাকে প্রায়ই ডাকে। আমি না শোনার ভান করি, রিকশা পেলে চলে যাই। রাতে যখন ফিরি তখনও দেখি সেই মহিলা সেখানে বসে থাকে। একদিন কৌতূহল হলো, কি বলে শুনতে।আমি ভয়ে ভয়ে কাছে গেলাম, সে নিজে নিজে কি যেন বলছিলো। লক্ষ্য করলাম, মহিলা একেবারে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে। আমাকে দেখে বলল,
তুমি কি ফার্স্ট বয়?
আমি মাথা নাড়ালাম। উনি বললেন,
এখন থেকে ফার্স্ট বয় হবে। তোমার কাছে কি টাকা আছে? আমাকে কিছু খাবার কিনে দিবে?
আমি উনাকে বাসায় নিয়ে আসলাম, আম্মা উনাকে খাওয়ালেন, মাথায় নারকেল তেল দিয়ে চুল আচড়ে দিলেন, পান বানিয়ে দিলেন। পরে জেনেছিলাম, উনি আমাদের এখানের একটা মিশনারি স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। আশির দশকে মাস্টার্স করেছিলেন। হঠাত করে মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। ছেলেরা এই উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নিতে চাইলো না, তাই ঘর থেকে বের করে দিলো। আম্মা মহিলাকে চিনেছিলেন, আমার এক ভাগ্নীকে স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে উনি সাহায্য করেছিলেন।
আরো কয়েকদিন পরে হঠাত দেখি দোকানের পাশে জটলা। ভীর ঠেলে গিয়ে দেখি, মহিলাটি একটা লোকের চুল ধরে ঝুলে আছেন, কোনোমতেই ছাড়ানো যাচ্ছে না, তাকে আমি কখনো এতো হিংস্র দেখিনি।পরে জেনেছিলাম্ লোকটি মহিলাটিকে খাবার কিনে দিয়েছিলো আর বলেছিলো তাঁর ছেলেগুলো সব জানোয়ার। মহিলা নিজ সন্তানের এই অপমান সহ্য করতে পারেনি।
আমরা বইপত্রে মহামানবদের জীবনী পড়ি, তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করি অথচ প্রতিটা ঘরে একটা করে মহামানবী আছে তাঁর খোজ নেই না। একটা গানে শুনেছিলাম্ মায়ের দুধের দাম গায়ের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে দিলেও শোধ হবে না, খুবই সত্য কথা। মায়েদের ঋণ পরিশোধ করার মতো ক্ষমতা কারো নেই, কিন্তু আমরা অন্তত ঋণ স্বীকার করতে পারি। সন্তানের হাসিমুখই মায়ের সবেচেয়ে বড় চাওয়া, অন্তত সেটা দিন। প্রতিদিন অন্তত একঘন্টা মায়ের সাথে কাটান, তাঁর কথা শুনুন, হাসিমুখে কথা বলুন। জীবনে আমরা কত পাপ করি, আমার বিশ্বাস মাকে দেয়া এই এক ঘন্টায় অনেক পাপ কেটে যাবে।
ওবায়েদ হক।
No comments :
Post a Comment