মা

মা
মা দিবসের শুভেচ্ছা

Thursday, May 15, 2014

আমার মা,আমার সবকিছু

স্নায়ু-চাপের খুব বড় ধরণের একটা অসুস্থতা দেখা দিয়েছিল একবার। তখন আমি সবে মাত্র প্রাইমারি থেকে হাই স্কুলে উঠেছি। সময়টাও বার্ষিক পরীক্ষার আগ দিয়ে। না স্নায়ু-চাপের কারণ পড়ালেখা কিংবা পরীক্ষার জন্যে নয়। কারণটা আমার পিতৃতুল্য কাউকে হারানো। খুব মনে আছে, আমি পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে খুব কষ্টে ঘাড়ের ব্যথা সহ্য করে বাড়ির সামনে পর্যন্ত পৌঁছেই "আম্মা" বলে চিৎকার দিয়েই জ্ঞান হারিয়েছিলাম। এরপর প্রায় ঘণ্টা ৩ আমার কোন ধরণের স্মৃতি নেই। ঘণ্টা তিন পর নিজেকে ঘরের খাটে আর আমার চারপাশ জুড়ে পুরো ঘর কানায় কানায় ভরা আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশী সমেত আবিষ্কার করি।
এর মধ্যেই আব্বা ঢাকা থেকে ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছেন (ঐ সময় মোবাইল ফোন ছিল না, আর যোগাযোগ একমাত্র ল্যান্ডফোন দিয়ে করতে হতো। সেটাও তখন আমাদের নেই। বাজারে থেকেই ঢাকায় অবস্থিত স্বল্পপরিচিত এক চাচাকে ফোন করে তাকে ডাক্তার নিয়ে আসার অনুরোধ করেন আব্বা)। ডাক্তার আমার পালস কিছুক্ষণ পরপর চেক করছে আর ফ্যাকাসে মুখ করে বার বার ঘড়ি দেখছে। জেগে উঠার মিনিট ১০ পার হবার আগেই আবার ব্যথা শুরু হয়, আর প্রায় সাথে সাথেই জ্ঞান হারাই ২য় বারের জন্যে। এর পর জ্ঞান ফিরে অনেক পরে, প্রায় এশার আজান হয়ে যাবার পর। এই সময়ের মাঝে ভিটামিন আর বিভিন্ন ঔষধ সহকারে স্যালাইন দেয়া হয় আমাকে। ঐদিন রাতে আর কোন সমস্যা হয়নি, সে যাত্রায় এতটুকুতেই পার পেয়েছিলাম।
এবার আম্মার কথায় আসি। আমি যখন দুপুরে "আম্মা" বলে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তার উপরই পড়ে যাই তখন বাড়িতে আম্মা আর দাদী ছাড়া কেউ ছিল না। চিৎকার শুনে আম্মাই দৌড়ে বেরিয়ে আসে আর রাস্তা থেকে ঘরে নিয়ে যায়। কেউ একজন আব্বাকে খবর দিতে বাজারে যায় আর আব্বা তখনই ডাক্তার আনার জন্যে চাচাকে ফোন করে বাসায় ফিরে আসে। ততক্ষণে আম্মা আমার মাথায় বালতি কয়েক পানি ঢেলে একাকার করে ফেলেছেন (ঐ সময় চাপকল দিয়ে পানি তুলে ব্যবহার করতে হতো)। তারপর তার কোলে আমার মাথা রেখে সেই যে বসেছেন তারপর একেবারে পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গার পর সেই বসা থেকে উঠেছেন।
এরপর কি করেছেন তার ছোট করে বলতে গেলেও অনেক বড় হয়ে যাবে। শুধু এতটুকু বলি, আম্মা এখনো যদি ভাত মাখিয়ে না দেয় তবে খেতে পারি না। এমন তো কিছু না সেই একই রান্না তবুও আম্মা যদি ভাত মাখিয়ে না দেয় তবে তা খেয়ে ঐ স্বাদ পাই না যেটা আম্মা মেখে দিলে পাই।
এখনো বাইরে কোথাও গেলে গড়ে ঘণ্টা খানিকের ভেতরে আম্মা একবার ফোন করেই। আর সেটা রিসিভ না করতে পারলে বাসায় আসলে ঝাড়ি এখনো শুনতে হয়। প্রতিটা প্রয়োজনের জিনিষ এখনো আম্মার কাছেই আবদার করি আর আম্মাও ছোটবেলার মত এখনো সেগুলি পূরণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। আমি সাধারণত কারো সাথে তর্ক করতে পারি না। তাই মাঝে মাঝে রাগ করে খাওয়া-দাওয়া কথা-বার্তা বন্ধ করে দেই। কিন্তু সেখানেও আম্মা হাজির। রাগটা যদি তার সাথেও করি বকা দিয়ে হোক আর রাগ ভাঙ্গানোর কথা দিয়েই হোক, আম্মাই সেটা করে।
জানিনা তার ত্যাগ আর ভালোবাসার ঋণী হয়ে কতটুকু কি করতে পারবো তার জন্যে, তবুও প্রার্থনা আল্লাহ যেন আমার দ্বারা কখনো তার মনে কোন কষ্ট না দেয়।
ভালো থাকুক আম্মা'রা, ভালোবাসায় থাকুক তাদের সন্তানেরা......

সবজান্তা মা এবং কিচ্ছু না পারা বাবু

(১) গ্রামের নাম অর্জুনতলা। নাম শুনলেই অনেকের মনে হতে থাকবে,বিরাট কোন অর্জুন গাছের ছায়ায় বুঝি গড়ে উঠেছে এ গ্রাম! যদিও আমি আজ পর্যন্ত অমন দৈত্যাকৃতির কোন অর্জুন গাছ দেখিনি। থাকলে,আমার চোখে তো পড়তই। এ গ্রামের সবকিছু যে আমার নখদর্পণে! "কী ভাবছিস অত? চাচীর কথা?" রানা ভাইয়ের প্রশ্নে,ভাবনায় ছেদ পড়ে আমার। নতুন ভাবনায় পড়ি। লুঙ্গির কোঁচড়ে ঝোলানো আমগুলোর স্পর্শ নিই একবার। এগুলো কিছুক্ষণ আগে,মাত্র চুরি করা। ওপাড়ার বদি চেয়ারম্যানের আমবাগান সাফ করে এসেছি একদম। ব্যাটা বহুত বজ্জাত। শান্তিকমিটির নতুন সদস্য। প্রচুর ভাব নিয়ে চলাফেরা করে। সুযোগ পেলেই থুতনীর ফিনফিনে কয়েকগাছি দাড়ি মুঠো করে ধরে। বিড়বিড় করে বলে, "জান থাকতে,পেয়ারের পাকিস্তান মালাউনদের হাতে যাবেনা।" "কীরে,চুপ মেরে আছিস যে?" এবার সফিক জানতে চায়। আমি উদাস কন্ঠে বলি, "রাতের অভিযান তো শেষ। এবার জননী সামাল দেয়ার অভিযানে নামতে হবে!" (২) "বাবু... এই বাবু... উঠে যা। আর কত ঘুমোবি? বেলা কতটা হয়েছে,সে খেয়াল আছে? বাবু?" আমি কানে বালিশ চাপা দিলাম। প্রতি ভোরে এই একই দৃশ্য। মাকে বোঝাতেও পারিনা,ইনসোমনিক বলে সারারাত গ্রাম পাহারায় (!) কাটে আমার। ঘুমাই ভোরের দিকে। তাই সকাল আটটা ও আমার কাছে ভোররাত। আর ভোররাতে ওঠার মত যথেষ্ট বয়স্ক আমি নই। কিন্তু কে বোঝাবে এসব? স্বেচ্ছাসেবীর বড় অভাব এখানে। "উফ! চুপ থাকো। আমার সময় হলে,আমি নিজেই উঠব। তোমাকে ভাবতে হবেনা।" খেঁকিয়ে উঠি। তারপর আবার তলিয়ে যাই গভীর ঘুমে। মাঝে মাঝে ক্লাসগুলোও মিস হয়ে যায়,এই নেশাতুর ঘুমের ফলে! আর মায়ের হাহাকার শুনি তখন। "বাবু নামটা রেখে ভুলই করেছি। এতবড় হয়েছে। তবু কিচ্ছু ঠিকভাবে হয়না,এই ছেলের দ্বারা! কিচ্ছু না!!!" আর আমি বিরক্তিতে বিড়বিড় করি, "কে রাখতে বলছে,এই নাম?" এরপর জোরে রেডিও ছেড়ে দিই। দেশের হালচালে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করি। যাতে মায়ের হাহাকার আর না শুনতে পাই। কিন্তু বিধি বাম। রেডিওর সাথে পাল্লা দিয়ে,মায়ের কন্ঠের তীব্রতা বেড়ে যায়। "নাওয়া-খাওয়া ফেলে এখন রেডিও? ঐ বন্ধ কর বলছি! বাবু...." দু'হাতে কান চেপে ধরি। কত মেনে নেয়া যায়? "বাবু,এটা করিসনে।" "বাবু,ওসব খাসনে।" "ঠান্ডা লাগবে।" "ওটা কর।" "এখন ঘুমা।" "উঠে পড়,আর কত?" প্রায় সারাদিন মায়ের সতর্কবাণী,খবরদারী। মাঝে মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। চেঁচিয়ে জানতে চাই, "পেয়েছ কী আমাকে,হুঁ? বড় হতে দেবে না? নিজে সব শিখে উঠতে দেবে না? আর এত্ত জানো কেনো তুমি? একটু কম কম জানলে কী হয়,শুনি?" আমার সবজান্তা মা তখন কিচ্ছু বলেনা। মুখ টিপে,হাসে শুধু। যে হাসিতে পৃথিবীর সমস্ত মায়া জড়িয়ে আছে। বহু কষ্টে চোখ ফিরিয়ে নিই। ক্ষোভের অবশিষ্টাংশ বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। বিড়বিড় করে নিজেকেই শোনাই, "ভদ্রমহিলা দেখি মায়া লাগানোটাও ভালভাবেই শিখেছে! হুহ..." এই হল আমার মা! সাধু ভাষায়,"জননী"। যাঁর আচরণে মাঝে মাঝে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। মনে হতে থাকে-আমি বুঝি শুধু নামে নই ,আকৃতি এবং বয়সে ও বাবু রয়ে গেছি! (৩) "বাবু... যাসনে সোনামানিক আমার। যাসনে,বাবা। তোর মা যে বড্ড একা রে..." আমি দৌড়াচ্ছি। প্রাণপনে দৌড়াচ্ছি। মায়ের হাহাকার অগ্রাহ্য করে। মাকে ফাঁকি দিয়ে। দেশের যা অবস্থা। আমি কী করে ঘরে থাকি? কিন্তু আমার সবজান্তা মা সেটা বুঝবেননা। বুঝতে চাইবেন না,বাবার হত্যাকারীদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখতে আমার কেমন লাগে!তাইতো মাকে ফাঁকি দিয়েছি। বলেছি, "আলুভর্তা,ডাল আর ঘিয়ে ভাজা পোড়া মরিচ দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।" আর তিনি রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকতেই আমি পালিয়েছি। একছুটে পৌছে গেছি,রানা ভাইদের কাছে। রানা ভাইরা কয়েকজন আজ বর্ডার পেরিয়ে ইন্ডিয়া যাবেন। ওখানে নাকি গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ফায়ারিং শেখানো হবে। আমি অতকিছু বুঝিনা। শুধু বুঝি, শত্রুদের দিন ফুরিয়ে আসছে। আমার বাবার মত হাজারো বাবার মৃত্যুর মাশুল এবার গুণতে হবে তাদের। পকেট থেকে মায়ের ছবি বের করে বিড়বিড় করলাম, "এই একটাবার তোমার বাবুকে বড় হতে দাও,মা। কথা দিচ্ছি,ফিরে আসব। তারপর যত খুশী,খবরদারি করো।" (৪) "পরবর্তী দুই সপ্তাহের বেশী কেটে গেল,ট্রেনিংয়ে। গোলাগুলির শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সব বাছাইয়ে ভালভাবেই উতরে যেতে পেরেছিলাম। অস্ত্র হাতে নিতে অস্বস্তি লাগত প্রথম প্রথম। এখন চাপা উত্তেজণা কাজ করে। মনে হয়, পেরে যাব। মানিয়ে নিতে পেরেছিলাম আসলে। ওখানে খাবার দুইবেলা। তাও খুব সাধারণ। মাঝে মাঝে তো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তবু আমি সন্তুষ্ট। শক্ত মেঝেতে শুকনো পাতা কিংবা খড়ের বিছানায় ঘুমোতে,একদমই খারাপ লাগেনা। সিদ্ধান্ত অটল আমার। তাতে ফাটল ধরেনি। শুধু রাতে বিরেতে,ঘুমের মাঝেও তোমার স্পর্শ পেতে আকুলি বিকুলি করত মন। আর যখন তখন স্বপ্নে হানা দিতে তুমি। করুণ স্বরে বলতে, "বাবু,তুই কবে ফিরবি? ভাত তো জুড়িয়ে গেলোরে! পোড়া মরিচ নেতিয়ে গেছে। আলুভর্তা-ডাল বাসি। তুই ফিরবিনারে,বাবু? তোর মা যে বড্ড একা!" লাফ দিয়ে উঠে বসতাম।বাকী রাত নির্ঘুম কেটে যেত। ভ্রম হত মাঝে মাঝে। মনে হত,একটু ভালভাবে শ্বাস নিলেই তোমার গন্ধ পাবো...." থামলাম। স্মৃতি হাতড়াচ্ছি। মাকে বলার মত গল্প খুঁজছি,মনের এপাশ ওপাশ হাতড়ে। "জানো মা,দেশে ফেরার পর তোমার সাথে দেখা করার কোন সুযোগই পাইনি। আমরা ঘাঁটি গেড়েছিলাম,এখান থেকে বহুদূরে। তবে মনের মাঝে জেদ চেপে গিয়েছিল আমার,তোমার সাথে দেখা করবই। একদিন কাউকে না জানিয়ে,পথ ধরলাম আমাদের গ্রামের। বাড়ির কাছাকাছি আসামাত্রই ধরা পড়ে গেলাম। বদিউল চেয়ারম্যানের কথা মনে আছে,তোমার? বদি রাজাকার নামে চিনত লোকে। ঐযে বাবাকে একরাতে ডেকে নিয়ে গেল,বাড়ি থেকে? চারদিন পরে নদীতে ভেসে উঠল বাবার লাশ। আমার নীরিহ ভাল মানুষ বাবাটার চেহারা চেনার কোন উপায় ছিলনা সেদিন। পরনের ছিন্নভিন্ন কাপড় দেখে বুঝতে পেরেছিলাম,ওটা আমার বাবা। যে বেঁচে থাকলে হয়ত এখনও,আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোত। সে বাবা,যে আর কখনও রাজনীতি নিয়ে ছেলের সাথে আলোচনায় মেতে উঠবেনা! কথায় কথায় ছেলের সমর্থনে এগিয়ে আসবেনা। বাবার হত্যাকারী সেই বদি রাজাকার। চিনে ফেলল আমাকে। ধরে নিয়ে গেল তার বাড়িতে। সেটা তখন পাক মিলিটারির অস্থায়ী ক্যাম্প। সেখানে তার লোকেরা সারারাত মারল আমাকে। আঙ্গুলে এক এক করে পেরেক ঠুকল। আমি শুধু চেঁচিয়েছি। বারবার তোমাকে ডেকেছি গলা ফাটিয়ে। শেষরাতে বদি রাজাকার আমাকে দেখতে এসেছিল। গা জ্বালানো কথাবার্তা। অসহ্য হিংস্র হাসি। হঠাৎ কী ঘটে গেল আমার মাঝে,জানিনা! হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন হুঁশ হল,টের পেলাম আমি তাকে মেরে ফেলেছি। হ্যাঁ মা,তোমার কিচ্ছু না পারা বাবুটা সেদিন খালি হাতেই পিতৃহত্যার শোধ নিয়েছিল। পালালাম তারপর। বাড়িতে এসে দেখি,তোমার অভিমান মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।.... ধরাছোঁয়ার বাইরে তুমি। বাবুর অপেক্ষা আর সইলনা,তাইনা?.................... জানো মা,এখনও চোখ বন্ধ করলে তোমার গন্ধ পাই। তোমাকে দেখি। তুমি আমার জন্য খাবার সাজিয়ে বসে আছ। অভিযোগের সুরে বলছ, "বাবু এলি? ভাত তো জুড়িয়ে গেলোরে! খাবিনা?" এখনও হাঁটতে গেলে,বাতাসে তোমার হাহাকার শুনি। ফিসফিসানো কাতরধ্বনি, "বাবু যাসনে। তোর মা যে বড্ড একারে...." তুমিতো সবজান্তা! এটা জানতেনা,তোমার বাবু ফিরে আসবে? এটা জানতেনা,তুমি চলে গেলে সে একা হয়ে যাবে?........................তোমার কিচ্ছু না পারা বাবুটা আসলেই খুব একা,মা। বড্ড বেশী একা!!!" .........মা, তোর আঁচলে, চেনা গন্ধে নাক ডুবাই.. বুঝাই নিজেকে, আজ আমি অবাধে গাইতে পারি , বাংলার গান। আজ আমি স্বর-ব্যঞ্জন বর্ণ সাজিয়ে, একটা গল্প লিখতে পারি। লাল সবুজের গল্প! আজ আমি অবাক চোখে দেখতে পারি, ষোড়শীর লাজুক মুখ। প্রিয় বর্ণ সাজিয়ে, সযত্নে বলতে পারি- "ভালবাসি!!!"....... (৫) মাঝবয়সী এক লোক ,মাটির ছোটখাট একটা ঢিবির উপর আছড়ে পড়ে কাঁদছে। তার কান্নায় অদম্য আকুলতা।আকাশে অনেক মেঘ। বাতাস থম মেরে আছে। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামল। এটা হয়তবা ঈশ্বরের কান্না। কিংবা কোন প্রিয় মানুষের। কেননা,এ কান্নায় ও আকুলতা আছে। কষ্ট ধুইয়ে দেয়ার,কিংবা লুকিয়ে রাখার আকুলতা। প্রকৃতি গোপনীয়তা বড় বেশী পছন্দ করে।

মা আমার

বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয়। খাতায় কলমে একেবারে যাকে বলে রাশভারী আমার বাবা হচ্ছেন সেই ধরনের মানুষ। সেই ছোটবেলা থেকেই আমার সকল অযৌক্তিক দাবী দাওয়া,ন্যায় অন্যায় সকল আব্দারের একমাত্র আশ্রয়স্থল হচ্ছেন আমার মা। বাবা এবং আমার মাঝখানে মা বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করেন। আমি কখনো কিছু করতে হলে মায়ের কাছেই পরামর্শ চাই। তবে এ ব্যপারে আমি খুব সুবিধাবাদী। ভাল লাগলে মানি,নয়তো এ কান দিয়ে ঢুকাই অন্য কান দিয়ে বের করে দেই। মানে মোটকথা হচ্ছন মা সংসারের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে সকল দায়দায়িত্ব নিপুণভাবে সমাধা করছেন।

দশ মাস দশ দিন কথাটা খুব প্রবলভাবেই শোনা যায়,কিন্তু এর গভীরতাটা বুঝা যায়না। একজন মা তার সারাটা জীবনের সুখ বিসর্জন দিয়ে একটা প্রাণকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন,আদরে শাসনে তাকে বড় করেন। অথচ মায়ের কোন দায় পড়েনি সন্তানকে বড় করে তোলার। সেই ত্যাগের কথা,সেই কষ্টের কথা যখন একবাক্যেই শেষ করার চেষ্টা করি তখন নিজেকে হিপোক্রেট মনে হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে একটা সন্তান জন্ম দিতে একজন মায়ের ২০টি হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার সমপরিমাণ কষ্ট হয়। এটা অনুভব করাতো দূরের কথা কল্পনা করা ও দুঃসাহসের ব্যপার। সেই অবর্নণীয় ব্যথাকে মায়েরা অবলীলায় অগ্রাহ্য করেন। কতটুকু ঐশ্বরিক শক্তিপ্রাপ্ত হলে এরকম করা যায়। এত শুধু কষ্টের শুরু মাত্র। মায়েদের সারাটা জীবন সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতেই চলে যায়। ঘরে যখন চারটা পিঠা থাকে আর মানুষ থাকে পাঁচজন তখন মা হাসিমুখে বলবেন আমি পিঠা খাইনা,তোরা খা। 

ছোটবেলায় মায়ের শাড়ীর গন্ধ শুকে ঘুমাতে যেতাম। এখন অনেক বড় হয়ে গেছি,নিজে পথ চলতে শিখে গেছি,মায়ের আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু আজ ও যখন খুব মন খারাপ হয়,তখনতো মা ছাড়া আর কাউকে পাশে পাইনা। মা হলেন অব্যক্ত বেদনা ব্যক্ত করার জায়গা,গোপন দুঃখ নিঃসংকোচে বলার জায়গা।

আজকে মা দিবস। এটাতো শুধুই ফর্মালিটি,মায়ের ভালবাসা কি আর একদিনের হয়রে পাগলা। মায়ের ভালবাসা হচ্ছে চিরদিনের চিরকালের। মায়ের কাছ থেকে ভালবাসা শুধু আনাই হয়েছে,কখনো তা ফেরত দেওয়া হয়নি। কখনো বলা হয়নি মা তোমাকে অনেক ভালবাসি,কোনদিন বলা হবে কিনা তা ও জানিনা।

সবাইকে মা দিবসের শুভেচ্ছা। পৃথিবীর সব মায়েরা সুখী হোক,ভাল থাকুক মায়েরা

মায়ের জন্য যতো কিছু

আমি জহির । বাংলাদেশের স্বনামধন্য এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে আছি লেকচারার হিসেবে। আমার জীবনটা নিয়ে আমি অনেক স্বন্তুষ্ট। আমি আজ অনেক ভালো অবস্থায়। কিন্তু এখানে আসতে আমাকে যতটা না কষ্ট করতে হয়েছে তার চেয়ে হাজার গূন বেশি কষ্ট আমার মা করেছেন।

আজ থেকে আঠাশ বছর আগের কথা। রেহানা বেগমের কোল আলো করে আসে ছোট্ট ছেলে। ফুটফুটে ছেলে। অল্পশিক্ষিত মা জহির রায়হানের খুব ভক্ত ছিলেন। তাই ছেলের নাম দেয় জহির রায়হান। ছেলেটাকে পাশে শুইয়ে দিয়ে মা চিন্তায় পড়ে যান খুব।ছেলের জন্মদাতা যে এখনো বাংলা মদের দোকানে ফুর্তিতে আছে।

রেহানা বেগম ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করেন। নেশাগ্রস্থ পিতার সহচর্যে যেয়ে এই হিরার টুকরা ছেলেকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেয়া হবে। হলো ও তাই। নেশার জন্য বাবা ছেলেকে বিক্রির কথাও তুলে। আমার মা এসব শুনে সাথে সাথেই তার বাবার বাড়ি চলে যান আমাকে কোলে নিয়ে। ভেবেছিলেন হয়তো বা মাথা গোজার ঠাই হবে সেখানে।

তিন ভাই এর সংসারে আমার মা একমাত্র বোন। ছোট মামা ও বিয়ে করে ফেলেছিল। তিন ভাই এর জন্য তিনটি রুম ছাড়া আমার নানার বাড়িতে আর একটাও অতিরিক্ত রুম ও ছিল না। আর আমার মামিরা প্রায় সব কাজই নাকি আমার মা কে দিয়েই করাতো। আমার মা ও সব কাজ করতো। মামিদের কাপড় ধোয়া,মামাতো ভাই বোনদের খাওয়ার ব্যাবস্থা করা সব কিছু করতো।

কিন্ডারগার্টেন এর ছেলেদের দেখে আমার মা প্রায়ই ভাবতো তার ছেলে এরকম রঙ্গিন ড্রেস পরে স্কুলে যাবে। স্কুল গাড়ি এসে তার বাড়ির সামনে এসে বেল বাজাবে। মাথায় সিথি করে চুল আচড়িয়ে দিয়ে আমার টিফিন বক্স নিয়ে মা আমাকে এগিয়ে দিবে।

কিন্তু না!! আমার ভাগ্যে কিন্ডারগার্টেন জুটেনি। আমার মায়ের ইচ্ছেও পুরণ হয়নি। মায়ের অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ছয় বছর বয়সে আমাকে মাথার উপর হাত দিয়ে অপর পাশের কান ধরে ভর্তি হতে হয়েছে সরকারী স্কুলে। স্কুলের শিক্ষকরা আমার উপবৃত্তির ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রতি ছয় মাসে আমি তিনশো টাকা পেতাম। সেটা দিয়ে আমার খাতা কলম কিনে দিতো মা। ঠিক দুইশো পঁচানব্বই টাকা খরচ করতো মা। বাকি পাচ টাকা দিয়ে মা একটা ব্লাউজ কিনতো নিজের জন্য।

না,এভাবে বসিয়ে রেখে খাওয়াতে একেবারেই সমস্যা হচ্ছিল আমার মামা মামিদের। দুটো উটকো ঝামেলা এসে তাদের ঘাড়ে পড়বে তারা চিন্তাও করেনি কখনো। আমার মা কে বলা হলো পরের মাস থেকে বাড়ি থাকতে হলে খাওয়া থাকা বাবত টাকা দিতে হবে।উপায়ান্তর না পেয়ে আমার মা পাশের বাড়িতে কাজ করে। এক বাড়ির কাজ দিয়ে সংসার চলতো না।এক সময় আমার মা চারটা বাড়িতে বুয়ার কাজ করতো।

আমি এক ক্লাস দুই ক্লাস করে বড় হই। প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠার সময় আমি প্রথম হয়েছিলাম। মজার ব্যাপার হলো,যে ছেলেটি সেকেন্ড হয়েছে তাদের বাড়িতে আমার মা কাজ করতো। এবং টানা দুই ক্লাস আমি ফার্স্ট হবার কারণে আমার মায়ের চাকুরী যায় ও বাড়ি থেকে।

স্কুলের এক শিক্ষক আমার ভালো ফলাফল দেখে উনি আমাকে বিশ টাকা দিয়েছিলেন। সেদিন আমার খুব খুশি লেগেছিল। আমার মায়ের ছেড়া শাড়ি সেলাই করতে তিন টাকা, একটা সাবান কিনি সাত টাকায় আর বারো টাকা মা কে দিয়ে আসি।

আমার মা হণ্যে হয়ে খুঁজছিলেন একটা চাকরী। বুয়ার চাকরী। মা পেয়েও যায়। নিজের বাবার বাড়িতেই। আমার মেঝ মামার ঘরের সব কাজ করে দেন তিনি। আমার মামি আমার মা কে আর নাম ধরে ডাকেনা। 'বুয়া' বলে ডাকতো। একদিন আমি আমার মা কে জিগেস করি, 'মা, বুয়া মানে কি?' আমার মা হেসে উত্তর দেয়, 'বাবা, বুয়া মানে হলো যাদের তোর মতো একটা লক্ষী ছেলে আছে '।

কিন্তু না। আমি বুঝে যাই এটার মানেটা আমার মা আমাকে লুকিয়েছে। স্কুলে একটা ছেলের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিল। সে আমাকে বলেছিল,'তুই তো বুয়ার ছেলে '। আমি তাকে বললাম,'পারলে বুয়ার ছেলে হয়ে দেখা, আমার মা বলেছে যাদের আমার মতো একটা ভাল ছেলে আছে তাদের কে বুয়া বলা হয়।' ব্যাস মুহুর্তেই হাসির রোল পড়ে গেলো চারিদিকে। মা কে এসে কিচ্ছু বলিনি। শুধু জেনেছি এই শব্দটা খারাপ। শুধু বুঝেছি এটা আবার জিগেস করলে মা হয়তো রাগ করবে।

আমি প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে হাই স্কুলে উঠি। প্রাইমারি স্কুলে আমার বই ফ্রি তে দিতো সরকার। কিন্তু হাই স্কুলের বই নাকি কিনতে হয়।আমার মা আমার মামাকে বলেছিল। মামা আবেগী হয়ে পকেটে হাত দেয়ার সময়ই মামি এসে মামাকে টেনে রূমে নিয়ে যায়। ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয়। যেই সব বাড়িতে কাজ করতো তারাও কেউ দেয়নি টাকা। আমার মা গভীর চিন্তায় পড়ে যায়। পরের দিন সারাদিন মাকে আর দেখিনা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমার মা রাতে এসেছিল।দেখলাম তার হাতে ব্যান্ডেজ। আর হাতের মুঠোয় কিছু টাকা। কিছু বলিনি। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি মা আমার বই কেনার জন্য রক্ত বিক্রি করতো।

আমি পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পাই। সেখানের টাকা দিয়ে আমি নিজ হাতে মায়ের জন্য শাড়ি কিনি। আমার মা সে শাড়ি দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদে। আমি তখনো বুঝিনি মা কেন কাদছে। আশ্চর্যের ব্যাপার মা কে বাবার কথা বলতেই মা আমার উপর রাগ করতো। কখনোই কিছু বলতো না।

আমি অষ্টম শ্রেণী পাশ করার পর সবাই বলেছিল আমি যেন সাইন্স নিই। কিন্তু শুনেছি সাইন্সে নাকি অনেক খরচ। সব বিষয়ের প্রাইভেট পড়তে হয়। তখন আমার টাকা পয়সার বিষয়ে জ্ঞান বুদ্ধি হয়। আমি বুঝতে পারি আমার মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে। আমি তখন বুঝতে শিখেছি বুয়া মানে কি। ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানের প্রতি আমার ঝোক ছিল। বাশের ভেতর ব্যাটারি দিয়ে আমি টর্চ বানিয়ে একবার বিজ্ঞান মেলায় পুরষ্কার ও পাই। কিন্তু আমি সাইন্স নিতে পারিনি। আমি নিয়েছি কমার্স।কোন মতে আমার পড়াশোনা চলছে। ক্লাস নাইনে উঠেছি। এখন নিজের ও খরচ আছে। তাই আমি টিউশানি খুজি। একটা ক্লাস থ্রির ছেলেকে পড়ানো শুরু করি। আমার মা অনেক নিষেধ করেছিল কিন্তু আমি তো জানি হয়তোবা আমার খরচ জোগাড় করার জন্য আমার মা আরেক বাড়িতে কাজ নিবে।

এভাবে দিন যেতে পারতো। কিন্তু আমার তিন মামি কেন জানি আমার পড়ালেখা সহ্য করতে পারতো না। একদিন তো আমার বড় মামি কোন কারণ ছাড়া আমার হিসাববিজ্ঞান বই ছিড়ে ফেলে। সেদিন প্রথম আমার মা প্রতিবাদ করে।
তারপর থেকে আমার ছোট মামির ঘরে আমার মার চাকরী শেষ।

হিসাব বিজ্ঞান বই টা এমন দিনে ছিড়েছে পরের দিন আমার পরীক্ষা ছিল। মা বুঝতে পারে। কিন্তু মা এটা করবে আমি ভাবিনি। এক বাড়িতে ঘর ঝাড়ু দেয়ার সময় ত্রিশ টাকা চুরি করতে গিয়ে ধরা খায় আমার মা। সেদিন সেই বাড়ির চাকরীও যায়।

এবার মা কাথা সেলাই শুরু করে। এক মাসে একটা নকশী কাথা সেলাই করে দিতো মা । পাটি বানাতো। মোড়া বানাতো। এসব নিয়ে আবার হাট বারে বিক্রি করতো। আমার মা কখনো আমাকে বাজারে যেতে দেয়নি। অনেক বলতাম, 'মা তুমি বানাও আমি বিক্রি করবো। ' আমার মা বলতো,'না, এই বয়সে ছেলেরা বাজারে গেলে নষ্ট হয়ে যায়। ' আমিও চুপচাপ থাকতাম।

আমাদের ঘরটা ছিল ছোট্ট। একটা চৌকি আর সুপুরি গাছ দিয়ে বানানো একটা মাচা,যার উপর বই রেখে পড়াশোনা করতাম আমি।

আমার টিউশানির টাকা আর আমার মার কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে দিন চলে যায় আমাদের। কিন্তু বিনা দোষে আমার মামিরা আমার মার উপর অত্যাচার করত মানসিক ভাবে। একদিন মা বলেই দিলো,"এটা আমার বাবার বাড়ি। আমার সম্পত্তি বুঝিয়ে দেন"। তারপর থেকে মামিরা কথা বলতো না আর।

আমার নিজ মামাতো ভাই আমাকে 'বুয়ার ছেলে ' বলে ক্ষ্যাপাতো। একদিন আমি উত্তেজিত হয়ে তাকে থাপ্পড় দিই। সাথে সাথে আমার মামা বের হয়ে আমাকে প্রচন্ড আঘাত দেয়। আমার মা তখন অন্যের বাড়িতে কাজে ছিলেন। নইলে সেদিন অনেক বেশি কিছু হতো।

মেট্রিক পাশ করি আমি। বোর্ড স্ট্যান্ড হই। আমাদের দিন টা তখনই বদলে যায়। তিন চারটা টিউশানি পাই আমি। আমার মা কে বলি উনি যেন আর কারো বাসায় না যান। মাও আমার কথায় রাজী হয়ে অনেক বাড়িতেই কাজ ছেড়ে দেয়। শুধু একটা বাড়িতে কাজ রাখে। এটা নাকি উনার প্রিয় বাড়ি। কিন্তু একি? যার বাড়িতেই পড়াতে যাই সেই বলে,'আমার মা কি তাদের বাড়িতে কাজ করতে পারবে কিনা?' আমার বুক টা ফেটে যায় তখন। ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলি আমার মা বুয়া না।
বাধ্য হয়ে আমি পড়ানো ছেড়ে দিই। আবারো কষ্ট নামে আমাদের সংসারে।

গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে কিছু ছাত্র পাই আমি। প্রতিদিন হেটে হেটে গিয়ে আমি তাদের পড়াতাম। আমার মার একটাই স্বপ্ন তার ছেলে বড় হয়ে দেশের নামকরা একজন হবে। টিভির পর্দায় তাকে দেখবে দেশের লোকজন।

ইন্টার পরীক্ষা আমার মার সেই স্বপ্ন ভেঙে দেয়। অনেক দূরে প্রাইভেট পড়ানোর ফলে আমি অসুস্থ হয়ে যাই। পরীক্ষা দিতে পারিনি সেবার। আমার মা আমাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আর কোন টিউশানি নয়।যত টাকা লাগে আমি দিবো। '

আমার মা আবারো মানুষের বাড়িতে কাজ নেয়। পাটি বানায়। নকশী কাথা সেলাই করে। পুরো এক বছর আমার মা অনেক পরিশ্রম করে। পরের বছর ইন্টার পরীক্ষায় আমি ভালো ফলাফল করি। আশ্চর্য জনক ভাবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আই বি এ তে চান্স পাই।

আমাদের কষ্টের দিন শেষ। হলে উঠে আসি আমি। টানা ছয় মাস প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু টাকা জমিয়ে নিই আমি। এ ছয় মাস আমার মা বাড়িতে ছিল। মামিদের অত্যাচার সহ্য করে আর পাড়ার লোকের বাজে কথা শুনে। আমার মার নাকি ভাব বেড়ে গেছে। এখন আর কারো ঘরে কাজ করেনা। তার ছেলে যে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে!!

আমি মা কে নিয়ে আসি ঢাকাতে। বস্তি টাইপ একটা ঘর ভাড়া করি আমরা মা ছেলে। তখন জানতে পারি আমার বাবার কথা। এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। তাই মা আমাকে সব বলেছে। বাবার খোজে আমি বাড়ি যাই। শুনি আমার বাবা নাকি ড্রাগ কেনার জন্য নিজের কিডনী বিক্রি করেছিল। সেই ড্রাগ হাতে থাকা অবস্থায়ই বাবা মারা যায়।মা কে ঘটনা টা বলতেই আমার মা কেদে দেয়।হাজার হউক স্বামী তো।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় হই। প্রথম তিন জনের মা কে গোল্ড মেডেল দিবে। আমার মা কে আমি নিয়ে যাই। প্রাইভেট পড়িয়ে উপার্জিত টাকা দিয়ে মাকে কিনে দিই নতুন শাড়ি। সংসারে মোটামুটি অভাব নাই এখন।

গোল্ড মেডেল দেয়ার আগে প্রত্যেক মার বক্তব্য শোনানো হয়।আমার মার বক্তব্য শুনে আমাদের ভিসি কেদে দেয় আর প্রধান অতিথী প্রধানমন্ত্রী ও কেদে দিয়েছিলেন। তারা সবাই এতটাই আবেগাক্রান্ত হয়েছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী যাদের কে মেডেল পরিয়ে দেয়ার কথা সেই প্রধানমন্ত্রী আমার মা কে আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের তিন জনকে মেডেল পরিয়ে দেয়ার জন্য।

এরপর গত ছয় মাস আমি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি। লন্ডনের স্কলারশীপ পেয়েছি আমি। মা সহ যাবো তাই একটু দেরী করছি। ঢাকার বারিধারায় আমি একটা ফ্ল্যাট কিনি মায়ের জন্য। তিনটা কাজের লোক রেখেছি মায়ের সেবা করার জন্য। আশ্চর্যের ব্যাপার আমার মা তাদের কে কাজ না করিয়ে গল্প করে তাদের সাথে। মাকে জিগেস করতেই মা বলে,'আমিও তো এক সময় তাদের মতোই ছিলাম বাবা। '

আমি কিচ্ছু বলিনি। আমার মায়ের পরনে এখন আর ছেড়া শাড়ি নেই। নবরূপা থেকে কেনা শাড়ি আমার মায়ের পরনে। মা এখন আর মোটা চালের ভাত খায় না। আমি যে তার জন্য নাজির শাইল কিনি।
আমার মায়ের জন্যই তো এত দুর আসা আমার.....

Sunday, May 11, 2014

মা কে চিরবিদায় দেওয়ার দিনের ঝাপসা স্মৃতি



যাদের মা অনেক দূরে তারা যেমন তাদের মাকে মিস করে আমিও তেমনি খুব মিস করি আমার মাকে। কিন্তু তাদের এবং আমার মিস করার মধ্যে কোন মিল নেই। কারন, অনেকে হয়তো মায়ের কাছ থেকে সাময়িকভাবে দূরে আছে, হয়তো আবার ফিরে যাবেন মায়ের কোলে। কিন্তু আমার যে আর সেই সুযোগ নেই। আমি আমার সেই সাডে ছয় বছর বয়সে আমার প্রাণপ্রিয় মাকে চিরবিদায় দিয়েছি।
আমার ঠিক স্পষ্ট মনে নেই সেদিনকার কথা। ২০০৩ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর, আমার মা ছিলেন আমার নানার বাডিতে। সেখানেই আমার শেষ ভাইয়ের জন্ম হয়েছিল। বাডিতে ছিলাম আমি আর আমার বাবা। আমার বাবা প্রতিদিন চলে যেতেন হাই স্কুলে (তিনি সেখানকার শিক্ষক), যাবার পথে আমাকে আমার কেজি স্কুলে পৌছে দিতেন (তখন আমি নার্সারীতে পডি)।
২৯ তারিখও প্রতিদিনের মত স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাবার সাথে স্কুলে যাবার জন্য বের হয়েছিলাম। হঠাত্করে একটা মোটরসাইকেলে করে আমার মেজ মামা এবং আরেকজন লোক তাডাতাডি করে আমার বাডিতে আসল এবং আমার বাবাকে কি যেন বলল (আসলে তারা সেদিন আমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ দিতে এসেছিল)। তারপর আমার মামা আমার ব্যাগটা খুলে বাডির ভেতর ছুডে মারল আর বলল 'আজকে স্কুলে যেতে হবে না'। আমি তখন দারুণ খুশি হয়েছিলাম (তখনো আমি বুঝতে পারিনি আমার মা মারা গেছেন)।
তারপর আমার বাবা আমাকে পুকুরপাডে অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি আসার আগ পর্যন্ত আমি সেখানে অপেক্ষা করার সময় পাশের বাডির একটা মেয়ে বলল 'তোর মা মারা গেছে'। আমি প্রথমে ভাবলাম সে আমার সাথে ঠাট্টা করছে, কিন্তু পরে তার সিরিয়াস কন্ডিশন এবং আমার বাবার অবস্থা দেখে চিন্তা করলাম হতেও পারে।
আমার বাবা একটা বেবীট্যাক্সি নিলেন এবং বললেন 'চুনতি' যাবেন, তখন আমি আরো নিশ্চিত হলাম ('চুনতি' ইউনিয়নে আমার নানার বাডি)।
আমি স্কুলের ড্রেস পডা অবস্থায় গাডিতে ওঠে পডেছিলাম।
গাডিতে ওঠার পর দেখলাম আমার বাবা খুব কাঁদছেন আর ড্রাইভারকে তাডাতাডি গাডি চালাতে বলছেন (আমার বাডি থেকে নানার বাডির দুরত্ব প্রায় ছয় মাইল)।
সম্ভবত সকাল আটটার দিকে আমরা সেখানে পৌছেছিলাম। সেখানে পৌছার সাথে সাথে বেশ কয়েকজন আমাকে বারবার কোলে নিতে থাকল এবং তারা আমাকে জডিয়ে ধরে কাঁদছিল। পুরো বাডিতে লোকে গিজগিজ করছিল।
ভেতরে যাওয়ার পর আমার ভাই সজীব'কে দেখলাম, সে আমার মায়ের সাথেই নানার বাডীতে এসেছিল (সজীব আমার ছোট ভাই, তখন তার বয়স ছিল দুই বছর)। একজন আমাকে বলল আমার তৃতীয় আরেকটা ভাই হয়েছে।
আমার মামা আমাকে কোলে নিয়ে গিয়ে আমার মা কে দেখাল। দেখলাম মা শুয়ে আছেন এবং চারপাশের লোকজন তার দিকে তাকিয়ে কাঁদছেন। কয়েকজন আমাকে বলল 'তোর একটা ছোট ভাই হয়েছে তো তাই তোর মা ঘুমিয়ে আছেন'। এই কথাটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি....
পরে যখন বুঝতে পারলাম মা মারা গেছেন তখন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
সবাই বলাবলি করছিল 'ডেলিভারীর সময় মারা গেছেন'। সে সময় আমি এই কথাটির মানে বুঝতেই পারিনি।
অনেক্ষন পর দেখলাম আমার মাকে খাটিয়ায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানতে পারলাম তাকে কবর দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি তখন ছোট থাকায় আমাকে নেওয়া হয়নি। তারপর আমি আর আমার বাবা ওই দিন জন্ম নেওয়া ভাইটাকে নিয়ে চলে এসেছিলাম। দুই বছর বয়সী যেই ভাই টা আমার
মায়ের সাথে নানার বাডিতে গিয়েছিল, সে ওখানেই ছিল।
এর অনেক বছর পরে আমি জানতে পারি যে আমার সর্বকনিষ্ঠ ভাইয়ের জন্ম দেওয়ার সময় তিনি মারা গেছেন।
সন্তানের জন্য একজন মা কতবড সেক্রিফাইজ করতে পারেন তার জলন্ত উদাহরণ আমার 'মা'
আমি এবং আমার দুই ভাই গত বারোটি বছর কাটিয়েছি মাতৃহীন অবস্থায়। হয়তো ভবিষ্যতের দিনগুলোও এভাবেই কাটবে।
এখন সারাজীবন মাকে শুধু মিস করেই যাবো কিন্তু কোনদিন মাকে ফিরে পাবো না।
একটা বড রকমের আফসোস হয় আমার মায়ের কবর আমার নানার বাডীতে, তাই নিয়মিত কবর জিয়ারত করতে পারি না। তারপরেও আমি নামাযের পর সবসময় মায়ের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করি। আপনারাও আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন।

আমার মা ---
নামঃ মোবরেকা খানম সিদ্দিকা (রেখা)
জন্মঃ ৩০ জুন ১৯৭০
মৃত্যুঃ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৩


লিখেছেন- শাহরিয়ার 

মাকে খুঁজি আমি

আমি মাকে খুঁজি
আমার মা অসাধারণ এক রমণী,
সেই মাকে আমি হাঁরিয়ে খুঁজছি।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যেত আমার
চোখ খোলেই দেখতাম মা দাঁড়িয়ে,
এখনতো আর মাকে দেখতে পায়না
তবে মা কি আমার গেঁছে হারিয়ে ?
তোমরা কি আমার মাকে দেখেছ?
আমি যে তাঁকে খুঁজে পাইনা আর,
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি মায়ের হাসি !
চোখ মুছে দেখি এতো ভোরের সূর্য ,
দূরে উড়তে দেখি মায়ের শাড়ির আঁছল!
ভুল এতো ধাঁন ক্ষেতে বাতাসের দোলা।
হঠাৎ খুঁজে পাই মায়ের শীতল স্পর্শ!
না আবার ভুল এতো ভোরের শিশির।
হঠাৎ জেগে দেখি মায়ের কোলে ঘুমিয়ে আছি!
হ্যাঁ এইতো আমার মা আমি তাঁকেই খুঁজছি।
অনেক দিন পর আমি মাকে খুঁজে পেয়েছি!
আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি দেশমাতৃকার কোলে।

লিখেছেন- ইমরুল 

মা থাকুক মায়ের মতই পবিত্র

একটু উল্টাভাবে কিছু কথা বলি ... মা'কে ভালোবাসেনা এমন মানুষ মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবেনা কিন্তু যখনই কোনও বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু হয় দেখা যায় অন্যজনকে মা তুলে গালি দেয়া হয়। তখন অন্যজনও আপনার মা তুলে গালি দেয়।
অন্যজন কতটুকু কষ্ট পায় জানিনা তবে আপনি ঠিকই আপনার মা'কে গালি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে ফেলেন। আপনার কারনে , আপনার মা গালি খাচ্ছে ... চিন্তা করে দেখেন কেমন লাগে।
-রাজনীতি নিয়ে ঝগড়া লাগলে , মা'কে তুলে গালি দেয়া হয়
-খেলাধুলা নিয়ে ঝগড়া লাগলে , মা'কে তুলে গালি দেয়া হয়
-ধর্ম নিয়ে ঝগড়া লাগলে , মা'কে তুলে গালি দেয়া হয়
মা তুলে কেন গালি দেয়া হয় ... মা কি দোষ করল এইটা এখনো মাথায় ঢুকে নাই। পৃথিবীতে খারাপ মা বলে মনে হয় কিছু নেই ... মা'কে শুধু ভালোবাসা যায় ... গালি দেয়া যায় না।
কেউ একজন বলছিল,"আমি প্রথম দর্শনে ভালোবাসায় বিশ্বাসী, কারন পৃথিবীতে আসার পর চোখ খুলেই আমার মা'কে ভালোবেসেছি"

লিখেছেন- MOYLA BABA

মা দিবস নিয়ে বলি

মধ্যবিত্ত আটপৌড়ে সংসারে মায়েদের আলাদা বিশেষ পরিচয় থাকেনা, থাকেনা গুছিয়ে বলার মত কোন গল্প। সকালের রুটি, দুপুরে ভাত, সন্ধ্যার সন্তানের বাড়ি ফেরা নিয়ে উৎকন্ঠা, রাতের খাবারে কম পড়ে গেলে, মায়ের মিথ্যা বলায় মিশে থাকে আমাদের ভালবাসা। জ্বরের শরীরে ভেজা গামছায় ভালবাসা ছড়িয়ে যায় সমস্ত শরীরে। ঘুমিয়ে পরা ছেলের রুমের বন্ধ লাইট দেখেনা সারাদিনের ক্লান্ত মায়ের চোখ।
তাই যে আমাকে শরীরে ধারণ করেছে তাকে 'মা, তোমাকে খুব ভালবাসি' কথাটাও বলা হয়না কনদিন।
যদিও কেউ আড়ষ্টতা কাটিয়ে বলে ফেলে তাহলে মায়েরা লজ্জায় পড়ে যান। মা দিবসের খোঁজ না রাখা সকল মায়েদের শ্রদ্ধান্জলী।
এই লেখা কোন মায়ের হাতে পড়বে না জানি, সন্তানেরা অবশ্যই পড়বে। মা দিবস একটা উপলক্ষ, ঠিক আছে, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের মত মা দিবসের প্রয়োজনীয়তা যেন এদেশে কখনো সৃষ্টি না হয়। মায়েরা বেঁচে থাকুক সন্তানদের বুকে, সন্তান্দের ভালবাসার শত-সহস্র গুণ প্রতিদানে। 

লিখেছেন- কল্যান দাদা 

মায়ের ভালোবাসা :)

আমি তখন ছোট। একদিন চাচা ধরল! চাচা ধরলে আর ছাড়েনা। বল তোর মায়ের সম্পর্কে ১০ টা লাইন বল... আমি আমতা আমতা করে বলা শুরু করলাম! আম্মা সকালে খাবার দেয়... আম্মা দুপুরে খাবার দেয়... আম্মা রাতে খাবার দেয়... আমি চুপ, চাচা অবাক! শুধু খাবার দেয় আর কিছু করেনা? ঝাড়ি দিল চাচা? সেই ঝাড়িতে মনে পড়ল আম্মা আমাকে ঝাড়ি দেয়না, মারেনা। আমি বললাম, আম্মা খুব ভাল, মারেনা... এইটা শুনে চাচা বিশাল এক ধমক দিল! চাচার ধমক খেয়ে আমি গিয়ে আম্মার কাছে লুকাইলাম। আম্মা চাচাকে ইচ্ছামত বকা দিল। চাচা বলল, মাকে নিয়ে ১০ টা লাইন বলতে পারিস না আবার ঝাড়ি খাবার ভয়ে মায়ের কাছেই লুকায় থাকিস, লজ্জা করেনা? আমি এখন বড় হইছি। এখন হয়তো মাকে নিয়ে লিখতে বসলে ১০ টার জায়গায় ১০০ টা লাইন লিখতে পারবো। কিন্তু বাকি থেকে যাবে আরো হাজার হাজার লাইন। আর ঐ লাইনগুলোতেই আছে সন্তান জন্মদান থেকে শুরু করে তাকে লালন-পালন করতে গিয়ে একজন মায়ের অবর্ণনীয় কষ্ট করার কথা। ওগুলো মায়েরা আমাদের বুঝতে দেয়না। এমনকি মায়েরা কখনো আশাও করেনা সন্তান তাঁর কষ্টগুলো জেনে কষ্ট পাক। চাচার ঐ দিনের ঐ ঝাড়ির কথা মনে পড়ে। মা সম্পর্কে বলতে না পেরেও মায়ের কাছেই সাপোর্ট নিতে তাঁর কোলে লুকাইছি। মায়েরা এরকমই হয়! এক মা দিবসে তাঁকে নিয়ে লিখলে কি আর না লিখলেই বা কি! সে অন্য গ্রহের মানুষ, সন্তানকে সাপোর্ট দিবেই!

আপেল মাহমুদ

দুটো ঘটনা

১। আমি সাধারণত একেবারে বাধ্য না হলে হাসপাতালে যাই না। এর পেছনে একটা কারণও আছে। সাধারণত হাসপাতালে গেলে ভীত, অসহায় মুখগুলো দেখা যায়, আর্তনাদ আর কান্না ভাসে বাতাসে।মন খারাপ হয়ে যায়। শেষবার আমার ডাক্তার বন্ধুর সাথে দেখা করতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সে ওয়ার্ডে ছিলো। একটা প্রতিবন্ধী ছেলেকে দেখছিলো, পাশেই ছেলেটির মা বার বার আচল দিয়ে চোখ মুছছিলো। আর বার বার ছেলেটির বুকে হাত রেখে দেখছিলো বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছিলো কিনা। প্রতিবন্ধী ছেলেটি অচেতন হয়ে পরে ছিলো, ছেলেটির মা বার বার ছেলের কপালে হাতে চুমু খাচ্ছিল। চোখের পানিতে ছেলেটির কপাল ভিজে গেছে। ছেলেটির বয়স আঠারো হবে, কিন্তু সে উঠে বসতে পারে না, কথা বলতে পারে না। এই আঠারো বছর ধরে তার মা তাকে ছোট্ট শিশুর মত লালন করেছে। খাইয়েছে, নোংরা পরিষ্কার করেছে, সমাজের গঞ্জনাও সহ্য করেছে। তিনি তার মুখে মা ডাক শুনেননি, প্রথম হাটতে দেখে হাত তালি দেয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি, তার ছেলে স্কুল থেকে ফিরে তার কোলে ঝাপিয়ে পড়েনি, তিনি স্বপ্ন দেখেননি, তাঁর ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে কিংবা চাকরীর প্রথম বেতন দিয়ে শাড়ি কিনে আনবে। তবুও কেনো কোনো স্বপ্ন ছাড়া, কোনো স্বার্থ ছাড়া জীবনের সব শক্তি ব্যয় করে এই ছেলেটিকে বাঁচিয়ে রাখলেন, কেনো তাঁর বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দটি শোনার জন্য চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছেন? সেই রহস্য আমি ভেদ করতে পারিনি কেউ পারবে না। এই রহস্যকেই সম্ভবত মাতৃত্ব বলে। আমার বন্ধুকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলাম, অবস্থা কেমন। সে শুধু মাথা নাড়ালো। একটু পর ছেলেটির মা আমার ছেলেটির বুকে হাত দিয়েই চমকে উঠলো, বুকটা স্থির হয়ে আছে। তিনি আমার বন্ধুর পায়ে জড়িয়ে ধরলেন। উনুনয় করে বললেন, আমার পোলার বুক থাইম্যা গেছে, কিছু করেন স্যার। তারপর ছেলের মাথাটা নিজের কোলে উঠিয়ে কপালে গালে চুমু খেতে লাগলেন। আদর করে ডাকতে লাগলেন, তারপর আবার বুকে হাত দিলেন। তারপর আর্তনাদ করে উঠলেন, সেই দৃশ্য আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারিনি। তারপর থেকে আমি আর হাসপাতালে যাইনি। মায়েদের আর্তনাদ শোনার ক্ষমতা আমার হয়নি। ২। আমাদের বাসার সামনে কিছু দোকানপাট আছে, সেখানে প্রায়ই দেখি উষ্কখুষ্ক চুল, ছেড়া ময়লা জামা পরা একটা পাগল মহিলা রাস্তায় বসে নিজে নিজে কথা বলে। আমি যখন রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকি আমাকে প্রায়ই ডাকে। আমি না শোনার ভান করি, রিকশা পেলে চলে যাই। রাতে যখন ফিরি তখনও দেখি সেই মহিলা সেখানে বসে থাকে। একদিন কৌতূহল হলো, কি বলে শুনতে।আমি ভয়ে ভয়ে কাছে গেলাম, সে নিজে নিজে কি যেন বলছিলো। লক্ষ্য করলাম, মহিলা একেবারে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে। আমাকে দেখে বলল, তুমি কি ফার্স্ট বয়? আমি মাথা নাড়ালাম। উনি বললেন, এখন থেকে ফার্স্ট বয় হবে। তোমার কাছে কি টাকা আছে? আমাকে কিছু খাবার কিনে দিবে? আমি উনাকে বাসায় নিয়ে আসলাম, আম্মা উনাকে খাওয়ালেন, মাথায় নারকেল তেল দিয়ে চুল আচড়ে দিলেন, পান বানিয়ে দিলেন। পরে জেনেছিলাম, উনি আমাদের এখানের একটা মিশনারি স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। আশির দশকে মাস্টার্স করেছিলেন। হঠাত করে মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। ছেলেরা এই উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নিতে চাইলো না, তাই ঘর থেকে বের করে দিলো। আম্মা মহিলাকে চিনেছিলেন, আমার এক ভাগ্নীকে স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে উনি সাহায্য করেছিলেন। আরো কয়েকদিন পরে হঠাত দেখি দোকানের পাশে জটলা। ভীর ঠেলে গিয়ে দেখি, মহিলাটি একটা লোকের চুল ধরে ঝুলে আছেন, কোনোমতেই ছাড়ানো যাচ্ছে না, তাকে আমি কখনো এতো হিংস্র দেখিনি।পরে জেনেছিলাম্‌ লোকটি মহিলাটিকে খাবার কিনে দিয়েছিলো আর বলেছিলো তাঁর ছেলেগুলো সব জানোয়ার। মহিলা নিজ সন্তানের এই অপমান সহ্য করতে পারেনি। আমরা বইপত্রে মহামানবদের জীবনী পড়ি, তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করি অথচ প্রতিটা ঘরে একটা করে মহামানবী আছে তাঁর খোজ নেই না। একটা গানে শুনেছিলাম্‌ মায়ের দুধের দাম গায়ের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে দিলেও শোধ হবে না, খুবই সত্য কথা। মায়েদের ঋণ পরিশোধ করার মতো ক্ষমতা কারো নেই, কিন্তু আমরা অন্তত ঋণ স্বীকার করতে পারি। সন্তানের হাসিমুখই মায়ের সবেচেয়ে বড় চাওয়া, অন্তত সেটা দিন। প্রতিদিন অন্তত একঘন্টা মায়ের সাথে কাটান, তাঁর কথা শুনুন, হাসিমুখে কথা বলুন। জীবনে আমরা কত পাপ করি, আমার বিশ্বাস মাকে দেয়া এই এক ঘন্টায় অনেক পাপ কেটে যাবে। ওবায়েদ হক।

মা কি ?

মা হচ্ছে পৃথিবীর সেই একমাত্র মানুষ যাকে আপনি তখনও ধমক দিতে পারবেন, যখন ভুলটা আপনার। মা হচ্ছে সে যার ব্যাপারে আপনি নিশ্চিতভাবে জানেন, আপনার যে জিনিসটা আপনি অনেকদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছেন না তা সে ঠিকঠাক কয়েক মিনিটেই খুঁজে বের করতে পারবে। মা হচ্ছে সে যে আপনার পক্ষ নিয়ে অন্যের সাথে লড়বে, এটা জেনেও যে দোষটা আপনার ! মা হলো যার নিজের ওষুধ খাওয়ার সময়সূচি মনে না থাকলেও আপনি ঠিকই জানেন, আপনারটা সে মনে করিয়ে দেবে। মা হচ্ছে সেই একজন ব্যক্তি যাকে আপনি অনেক প্রস্তুতি নিয়ে ভালোবাসি বলতে গিয়ে শুধু এটুকু বলেই ফেরত আসেন, "ভাত হয়েছে ?" মা হচ্ছে এমন এক শ্রমিক, যে মে দিবসেও ছুটি পায়না। এবং আশ্চর্যজনকভাবে, মা দিবসেও না!
লিখেছেন- সামিউল আজিজ সিয়াম

মা এবং মা দিবস

মা (ইংরেজি: Mother, Mum, Mom) হচ্ছেন একজন পূর্ণাঙ্গ নারী, যিনি গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম তথা সন্তানকে বড় করে তোলেন - তিনিই অভিভাবকের ভূমিকা পালনে সক্ষম ও মা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। প্রকৃতিগতভাবে একজন নারী বা মহিলাই সন্তানকে জন্ম দেয়ার অধিকারীনি। গর্ভধারণের ন্যায় জটিল এবং মায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অবস্থানে থেকে এ সংজ্ঞাটি বিশ্বজনীন গৃহীত হয়েছে। মা শব্দের সমার্থক শব্দ হচ্ছে - জননী, গর্ভধারিণী, আম্মা, আম্মু, আম্মাজান, আম্মী, মাম্মি, মাতা ইত্যাদি। সাময়িক মোহ, সাময়িক দামী বা অন্য কিছু হয়ত এ শব্দটির চেয়েও অন্য কোনো শব্দকে খানিকটা প্রিয় করে তোলে, কিন্তু খুব অচিরেই তা বড় ‘ভুল’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। মা, মা, এবং মা। প্রিয় এবং মূল্যবান শব্দ একটিই, এবং একটিই মাত্র। শুধু প্রিয় শব্দই নয়, প্রিয় বচন -মা। প্রিয় অনুভূতি -মা। প্রিয় ব্যাক্তি –মা। প্রিয় দেখাশুনা –মা। প্রিয় রান্না -মা। প্রিয় আদর -মা। সব ‘প্রিয়’ গুলোই শুধুমাত্র মাকে কেন্দ্র করেই সব প্রিয় স্মৃতি। কারণ মা-ই পৃথিবীতে একমাত্র ব্যাক্তি যে কিনা নিঃশর্ত ভালবাসা দিয়েই যায় তার সন্তানকে কোন কিছুর বিনিময় ছাড়া। পৃথিবীর ইতিহাসে সন্তানের জন্মদাত্রী হিসেবে প্রাকৃতিকভাবেই মায়ের অবস্থান। মানব সমাজে যেমন মা-এর অবস্থান রয়েছে, পশুর মধ্যেও মাতৃত্ববোধ প্রবল। সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই মা, সকল মমতার আধার ও কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষায়ই "মা"-এর সমার্থক শব্দটি 'ম' ধ্বনি দিয়ে শুরু হয়। ধর্মে মায়ের অবস্থান অনেক পবিত্র এবং মুল্যবান একটি অবস্থান। আল কুরআনে বলা হয়েছে আমি মানুষকে তাদের পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জোর নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করার জোর প্রচেষ্টা চালায়, যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তাদের আনুগত্য করো না। আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমি তোমাদেরকে বলে দেব যা কিছু তোমরা করতে। একটি হাদীসে ইসলামের নবী মুহাম্মদ বলেছেন, মাতার পদতলে সন্তানের বেহেশত। সনাতন ধর্মে উল্লেখ আছে স্ববংশবৃদ্ধিকামঃ পুত্রমেকমাসাদ্য..”। আবার সন্তান লাভের পর নারী তাঁর রমণীমূর্তি পরিত্যাগ করে মহীয়সী মাতৃরূপে সংসারের অধ্যক্ষতা করবেন। তাই মনু সন্তান প্রসবিনী মাকে গৃহলক্ষ্মী সম্মানে অভিহিত করেছেন। তিনি মাতৃ গৌরবের কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন এভাবে- উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচায্যাণাং শতং পিতা। সহস্রন্তু পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে” [ (মনু,২/১৪৫) অর্থাৎ “দশজন উপাধ্যায় (ব্রাহ্মণ) অপেক্ষা একজন আচার্য্যরে গৌরব অধিক, একশত আচার্য্যরে গৌরব অপেক্ষা পিতার গৌরব অধিকতর; সর্বোপরি, সহস্য পিতা অপেক্ষা মাতা সম্মানার্হ।” এমনি প্রতিটি ধর্মে মায়ের অমূল্য হওয়ার সাক্ষ্য রয়েছে। মাকে নিয়ে অনেক গান, কবিতা, গল্প, কাহিনী রচিত হয়েছে। মাকে নিয়ে কাব্য কবিতার সংরক্ষিত একটি ওয়েবসাইট হল www.amarma.com.bd. মা দিবসের ইতিহাস এবং আচারানুষ্ঠান: -------------------------------------- বিশ্বের সর্বত্র মায়ের এবং মাতৃত্বের অনুষ্ঠান উদযাপন করতে দেখা যায়। ইতিহাস থেকে বলা যায় এ গুলোর অনেকই প্রাচীন উৎসবের সামান্য প্রামাণিক সাক্ষ্য, যেমন, সিবেল গ্রিক ধর্মানুষ্ঠান, হিলারিয়ার রোমান উত্সব যা গ্রিকের সিবেল থেকে আসে, অথবা সিবেল এবং হিলারিয়া থেকে আসা খ্রিস্টান মাদারিং সানডে অনুষ্ঠান উদযাপন। কিন্তু, আধুনিক ছুটির দিন হল একটি আমেরিকান উদ্ভাবন যা সরাসরি সেই সব অনুষ্ঠান থেকে আসেনি। তা সত্ত্বেও, কিছু দেশসমূহে মা দিবস সেই সব পুরোনো ঐতিহ্যের সমার্থক হয়ে গেছে। ছুটির দিনটি ক্রমে এত বেশি বাণিজ্যিক হয়ে পড়ে যে এটির স্রষ্টা আনা জার্ভিস এটিকে একটি "হলমার্ক হলিডে" অর্থাৎ যে দিনটির বাণিজ্যিক প্রয়োজনীয়তা অভিভূত করার মতো, সেই রকম একটি দিন হিসাবে বিবেচিত করেন। তিনি শেষে নিজেরই প্রবর্তিত ছুটির দিনটির নিজেই বিরোধিতা করা শুরু করেন। একটি গোষ্ঠীর মতে এই দিনটির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রীসের মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে যেখানে গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সিবেল-এর উদ্দেশ্যে পালন করা হত একটি উৎসব। এশিয়া মাইনরে মহাবিষ্ণুব -এর সময়ে এবং তারপর রোমে আইডিস অফ মার্চ (১৫ই মার্চ) থেকে ১৮ই মার্চের মধ্যে এই উৎসবটি পালিত হত। প্রাচীন রোমানদের ম্যাত্রোনালিয়া নামে দেবী জুনোর প্রতি উৎসর্গিত আরো একটি ছুটির দিন ছিল, যদিও সেদিন মায়েদের উপহার দেওয়া হত। মাদারিং সানডের মতো ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে দীর্ঘকাল ধরে বহু আচারানুষ্ঠান ছিল যেখানে মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট রবিবারকে আলাদা করে রাখা হত। মাদারিং সানডের অনুষ্ঠান খ্রিস্টানদের অ্যাংগ্লিকানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকার অঙ্গ। ক্যাথলিক পঞ্জিকা অনুযায়ী এটিকে বলা হয় লেতারে সানডে যা লেন্টের সময়ে চতুর্থ রবিবারে পালন করা হয় ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার ও "প্রধান গির্জার" সম্মানে। প্রথানুযায়ী দিনটিকে সূচিত করা হত প্রতিকী উপহার দেওয়া এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রান্না আর ধোয়া-পোছার মত মেয়েদের কাজগুলো বাড়ির অন্য কেউ করার মাধ্যমে। মা দিবস ছাড়াও বহু দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয় ৮ই মার্চ। জুলিয়া ওয়ার্ড হোই রচিত "মাদার্স ডে প্রক্লামেশন" বা "মা দিবসের ঘোষণাপত্র" মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস পালনের গোড়ার দিকের প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে অন্যতম। আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ১৮৭০ সালে রচিত হোই-এর মা দিবসের ঘোষণাপত্রটি ছিল একটি শান্তিকামী প্রতিক্রিয়া। রাজনৈতিক স্তরে সমাজকে গঠন করার ক্ষেত্রে নারীর একটি দায়িত্ব আছে, হোই-এর এই নারীবাদী বিশ্বাস ঘোষণাপত্রটির মধ্যে নিহিত ছিল। ১৯১২ সালে আনা জার্ভিস স্থাপন করেন মাদার'স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন্(আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি) এবং "মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার" আর "মা দিবস" এইসব শব্দবন্ধের বহুল প্রচার করেন। "She was specific about the location of the apostrophe; it was to be a singular possessive, for each family to honour their mother, not a plural possessive commemorating all mothers in the world." মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস দ্বারা দিনটিকে সরকারী ছুটির দিন হিসাবে অনুমোদন করার জন্য বিল পাশের সময় আইনে এই প্রচারণারই সাহায্য নেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন এবং অনান্য মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা। আমেরিকান প্রেসিডেন্সি প্রজেক্ট থেকে প্রাপ্ত প্রেসিডেন্সিয়াল প্রক্লামেশনস বা রাষ্ট্রপতির ঘোষণাপত্র: • ৭১ - মাদার'স ডে প্রক্লামেশন, ফ্র্যন্কলিন ডি.রুজভেল্ট, ৩রা মে, ১৯৩৪। • প্রক্লামেশন ৩৫৩৫ - মাদার'স ডে, ১৯৬৩ , জন এফ.কেনেডি, ২৬শে এপ্রিল, ১৯৬৩। • প্রক্লামেশন ৩৫৮৩ - মাদার'স ডে , ১৯৬৮ লিন্ডন বি.জনসন, ২৩শে এপ্রিল, ১৯৬৪। • প্রক্লামেশন ৪৪৩৭ -মাদার'স ডে, ১৯৭৬, জেরাল্ড ফোর্ড, ৫ই মে, ১৯৭৬। • প্রক্লামেশন ৬১৩৩ - মাদার'স ডে , ১৯৯০, জর্জ বুশ, ১০ই মে, ১৯৯০। • প্রক্লামেশন ৬৫৫৯ - মাদার'স ডে, ১৯৯৩, বিল জে. ক্লিন্টন, ৭ই মে, ১৯৯৩। • প্রক্লামেশন ৮২৫৩ - মাদার'স ডে, ২০০৮, জর্জ ডব্লিউ.বুশ, ৮ই মে, ২০০৮। <উল্লেখ্য> সাধারণ ব্যবহৃত ইংরেজি ভাষাও Mother's Day (মায়ের দিন) এই একবচনান্ত সম্বন্ধ-পদটিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হিসাবে বিবেচিত করে, যদিও Mothers' Day ও (মায়েদের দিন, বহুবচনান্ত সম্বন্ধ-পদ) যে পাওয়া যায় না তা নয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দিনে মা দিবস পালিত হয়।গুগল অনুসন্ধানের ফলাফলের প্রবণতা পরীক্ষা করে দেখলে দেখা যাবে যে প্রাথমিকভাবে দুই রকমের ফল পাওয়া যায়, ক্ষুদ্রতর ফলটি মাদারিং সানডে-এর ব্রিটিশ প্রথা অনুযায়ী লেন্ট-এর চতুর্থ রবিবার এবং বৃহত্তর ফলটি মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছুটির দিনটিকেই অনান্য দেশ এবং সংস্কৃতি একরূপে গ্রহণ করে সেহেতু যুক্তরাজ্যতে মাদারিং সানডে বা গ্রিসের মন্দিরে যিশুর প্রাচীনপন্থী পুজার্চনার মত মাতৃত্বের সম্মানে বিদ্যমান অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য তারিখটিকে সেইরকমভাবে পাল্টে নেওয়া হয। ক্যাথলিক দেশগুলোতে ভার্জিন মেরি ডে বা ইসলামিও দেশগুলোতে পয়গম্বর মুহাম্মাদ-এর মেয়ের জন্মদিনের মত, কিছু দেশে সেখানকার প্রধান ধর্ম অনুযায়ী তারিখটি পাল্টে দেওয়া হয়। অন্য বহু দেশে ব্যবহৃত হয় সেই তারিখটি যেটির একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে, যেমন বলিভিয়া যে তারিখটি ব্যবহার করে একসময় ওই তারিখে ওখানকার নারীরা একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। বেশিরভাগ দেশেই মা দিবস হল একটি সাম্প্রতিক রীতি, যা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে ছুটির দিনটির রীতি অনুসারে চলে এসেছে। যখন অনান্য বহু দেশ ও সংস্কৃতি এটিকে গ্রহণ করে তখন এই দিনটিকে একটি অন্য মাত্রা দেওয়া হয়, বিভিন্ন পর্বের (ধর্মীয়, ঐতিহাসিক বা পৌরানিক) সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়, এবং একটি একদমই অন্য দিন বা বিভিন্ন দিনে এটিকে পালন করা হয়। কিছু কিছু দেশে বহু আগে থেকেই মাতৃত্বের প্রতি উত্সর্গিত কয়েকটি অনুষ্ঠান ছিল এবং সেইসব অনুষ্ঠানে মার্কিন মা দিবসের মত মায়েদের কার্নেশন (গোলাপী ফুল) এবং আরো অন্য উপহার দেওয়া হত। অনুষ্ঠান পালনের রীতিটি অনেক রকম। অনেক দেশে মা দিবস পালন না করলে এটিকে প্রায় একটি অপরাধ গণ্য করা হয়। অনেক দেশে আবার মা দিবস একটি স্বল্প-পরিচিত উত্সব যা মূলত প্রবাসী মানুষেরা পালন করে থাকে বা বিদেশী সংস্কৃতি হিসাবে মিডিয়া সম্প্রচার করে থাকে (U.K বা যুক্তরাজ্যে দীপাবলী পালনের মত)। ধর্ম ক্যাথলিক ধর্মে, দিনটি বিশেষভাবে ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার পূজায় সমর্পিত। হিন্দু ধর্মে এটিকে বলে "মাতা তীর্থ অনুসি " বা "একপক্ষব্যাপী মাতৃ তীর্থ যাত্রা" এবং হিন্দু ধর্মালম্বী দেশগুলোতে, বিশেষ করে নেপালে এটি পালিত হয়। দেশ আফ্রিকীয় দেশসমূহ বহু আফ্রিকীয় দেশ ব্রিটিশ প্রথানুযায়ী মা দিবস পালন করে, যদিও আফ্রিকার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মধ্যে মায়েদের সম্মানে এমন অনেক অনুষ্ঠান এবং উত্সব আছে যা আফ্রিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ গড়ে ওঠার বহু যুগ আগে থেকেই চলে আসছে। বলিভিয়া বলিভিয়ায় ২৭শে মে মা দিবস পালিত হয়। অধুনা কোচাবাম্বা শহরে ১৮১২ সালের ২৭শে মে সংঘটিত করনিলার যুদ্ধের স্মৃতিস্মারক হিসবে এই দিনটিকে মা দিবসরূপে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয় ৮ই নভেম্বর, ১৯২৭ সালে। এই যুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত অনেক মহিলাকে স্পেনীয় সৈন্যবাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। চীন চীনের মা দিবস ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, কার্নেশন সেখানে জনপ্রিয়তম উপহার এবং সবথেকে বেশি বিক্রিত ফুল। ১৯৯৭ সালে দরিদ্র মায়েদের সাহায্য করার জন্য, বিশেষ করে পশ্চিম চীনের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মায়েদের কথা মানুষকে মনে করানোর জন্য, এই দিনটিকে চালু করা হয়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র, পিপিল'স ডেইলি'র একটি নিবন্ধে ব্যাপারটির বিষয়ে লেখা হয় যে "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হলেও, চীনের মানুষ বিনা দ্বিধায় এই দিনটিকে গ্রহণ করেছে কারণ এটি একদমই এই দেশের রীতি মাফিক - মানে গুরুজনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা”। সাম্প্রতিককালে মেং জি -র মা, মেং মুয়ের স্মৃতিতে মা দিবসের সরকারী অনুমোদনের সমর্থনে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য লি হাংকি প্রচার করতে শুরু করেন এবং ১০০ জন কনফুসীয় পন্ডিত ও নীতিশাস্ত্রের অধ্যাপকদের নিয়ে চাইনিজ মাদারস' ফেস্টিভাল প্রমোশন সোসাইটি নামে একটি বে-সরকারী সংগঠন তৈরি করেন। ওরা এও বলে যে পাশ্চাত্যের কার্নেসানের বদলে দেওয়া হোক লিলি ফুল যা সন্তানরা বাড়ির বাইরে গেলে, প্রাচীন কালে চীন দেশের মায়েরা রোপন করতেন এটি যদিও কযেকটা মাত্র শহরে একটি বে-সরকারী অনুষ্ঠান হিসাবেই পালিত হয়। গ্রিস গ্রীসে, যিশু কে মন্দিরে পেশ করার ইস্টার্ন অর্থডক্স ফিস্ট ডের সঙ্গেই পালন করা হয় মা দিবস। যেহেতু থিওটকস ( ঈশ্বরের মাতা) যিনি এই ফিস্টের (ভোজ) বিশিষ্ট চরিত্র এবং তিনিই যিশু কে জেরুসালেমের মন্দিরে এনেছিলেন, তাই জন্য এই পরবটি মায়েদের সঙ্গে সংযুক্ত ইরান ২০ জুমাদা আল-থানি, মহম্মদ-এর মেয়ে ফাতিমা-র জন্মবার্ষিকীর দিন ইরানে পালন করা হয় মা দিবস। নারীবাদী আন্দোলনকে ইন্ধন যোগানো এবং ঐতিহ্য মাফিক আদর্শ পরিবারের মডেল তুলে ধরার জন্য ইরানীয় বিপ্লব-এরপর এটিকে এই দিনে পাল্টানো হয়। আগে শাহ রাজত্বে এটি ইরানীয় পঞ্জিকা মতে আজার ২৫শে পালিত হত জাপান প্রাথমিক ভাবে শোয়া যুগ -এ রানী কজুন -এর (রাজা আকিহিতো'র মা) জন্মদিনটিকেই মা দিবস হিসাবে পালন করা হত জাপান। এখন এটি একটি জনপ্রিয় দিন। বিশেষত কার্নেশন আর গোলাপ উপহার হিসবে দেওয়া হয় এই দিন। মেক্সিকো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে ১৯২২ সালে আলভারো ওব্রেগন সরকার মা দিবসের প্রচলন করেন এবং সেই বছরই এক্সেলসীয়র নামক সংবাদপত্রটি এই দিনটির সমর্থনে এক ব্যাপক প্রচার চালায়।[৩২] মা দিবসের সূত্র ধরে কনসারভেটিভ সরকার চেষ্টা করে পরিবারের মধ্যে মায়েদের আদর্শ ভূমিকাটিকে তুলে ধরতে কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা কে সমাজতান্ত্রিকরা সমালোচনা করে বলেন যে এর মাধ্যমে নারীর এক বাস্তব অস্বীকারকারী বাস্তব(আইরিয়াল)ধারণা তুলে ধরা হছে যেখানে নারীদের প্রয়োজন যেন শুধু প্রজনন ক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ। ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময়ে লাজারো কার্দেনাস সরকার মা দিবস কে একটি "দেশাত্মবোধক উত্সব" হিসবে তুলে ধরতে চেষ্টা করে। কার্দেনাস সরকার এই দিনটিকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করে: জাতীয় উন্নয়নে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটিকে মনে করানো,মেক্সিকানদের মায়ের প্রতি আনুগত্য কে কাজে লাগানো, মেক্সিকান মহিলাদের নতুন নীতিবোধে শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের ওপর থেকে চার্চ (গির্জা) ও ক্যাথলিকদের প্রভাব কমিয়ে আনা। স্কুলের (বিদ্যালয়) ছুটিটির পৃষ্ঠপোষকতা সরকারই করে। যাইহোক, থিয়েটারে অভিনীত নাটকগুলো এসব সরকারী নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করে। নাটকগুলিতে ধর্মীয় অনুসঙ্গ ও বিষয় থাকতই এবং সরকারী প্রচেষ্টা সত্তেও "জাতীয় উত্সব" ক্রমেই হয়ে ওঠে "ধর্মীয় অনুষ্ঠান"। রাষ্ট্রপতি মানুয়েল আভিলা কামাচো-র স্ত্রী, সলেদাদ ওরজকো গার্সিয়া, ১৯৪০ সালে মা দিবসের প্রচার শুরু করেন এবং এটিকে একটি সরকারী উত্সবে পরিনত করেন। এক সপ্তাহব্যাপী হয় ১৯৪২ সালে উত্সবটি এবং সেখানে ঘোষণা করা হয় যে প্রত্যেক মহিলা যারা সেলাই মেশিন বন্ধক রেখেছে তারা বিনা খরচে সেগুলো ফেরত পাবে মন্ট দা পিয়েদাদ থেকে। ওরজকোর প্রচারের ফলে ক্যাথলিক ন্যাশেনাল সাইনারকিস্ট ইউনিয়ন (UNS)দিনটির বিষয়ে গুরুত্তদান করতে শুরু করে। পার্টি অফ দ্য মেক্সিকান রেভলিউসনের (এখন PRI) সদস্যদের যেসব দোকান ছিলো সেখানে একটি নিয়ম চালু ছিল, সেটা হল মা দিবসের দিন সমাজের নিচু স্তরের মহিলারা সেই দোকানে গিয়ে বিনামূল্যে একটি উপহার তাদের পরিবারের জন্য নিয়ে আসতে পারতো। সাইনারকিস্টরা চিন্তিত ছিলেন যে এরমভাবে বস্তুবাদ আর নিচু স্তরের মানুষদের নিষ্ক্রীয়তাকেই প্রশ্রয় দেওয়া হছে যার ফলে দেশের সামাজিক সমস্যাগুলো আবার এসে পড়ছে। এখন আমরা ওই ছুটির দিনকে খুবিই সংরক্ষনশীল দিন হিসাবে দেখলেও, ১৯৪০ এর দশকে UNS ওই দিনটিকে সমসাময়িক আধুনিকরণ প্রচেষ্টারই একটি অঙ্গ হিসাবে দেখত। এই অর্থনৈতিক আধুনিকরণ ছিল মার্কিন আদর্শে অনুপ্রানীত ও সরকার এটিকে স্পনসর করত। আবার যেহেতু দিনটি মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে সেই জন্য বিষয়টিকে মেক্সিকান সমাজে পুঁজিবাদ ও বস্তুবাদ ঢোকানোর প্রচেষ্টা হিসাবেও দেখা হত। UNS এবং লেওন শহরের পাদ্রীবর্গ সরকারী নীতির মধ্যে মা দিবসকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলার, ঘরের কাজ পরিত্যাগ করে পুরুষদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তুলে সমাজে মহিলাদের সক্রিয় ভূমিকার বিষয় তুলে ধরার মত প্রয়াস দেখতে পায়। এই দিনটির মাধ্যমে ভার্জিন মেরির পুজাকেও ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলার চেষ্টা দেখতে পায় ওরা যা কিনা ওদের মতে আরো বহু ছুটির দিন কে ডি-ক্রিসচিয়ানিজ বা বি-খ্রিস্টীয়করনের বৃহত্তর চক্রান্তের অঙ্গ। ওরা এটির বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে প্রবল প্রচার চালায় এবং ধার্মিক মহিলাদের অনুরোধ করে সরকারী অনুষ্ঠানগুলোকে ডিপেগানাইজ" করার। ১৯৪২ সালে সলেদাদে মা দিবসের বিশাল অনুষ্ঠানের একই সময়ে লেওন শহরে পাদ্রীরা ভার্জিন মেরির 210 তম উত্সব পালন করে একটি বড় প্যারেড বা কুঁচকাওয়াজ সহ অনেক পন্ডিত এবিষয়ে একমত যে মেক্সিকান সরকার ১৯৪০ এর দশকে মা দিবস প্রচার সহ তাদের বৈপ্লবিক কার্যাবলী পরিত্যাগ করে। এখন মেক্সিকোতে মা দিবস মা এবং ভার্জিন মেরি দুজনেরিই উত্সব। নেপাল বৈশাখ(এপ্রিল) মাসে হয় "মাতা তীর্থে অনুসি " বা "একপক্ষব্যাপী মাতৃ তীর্থ যাত্রা"। এই উত্সবটি পালিত হয় অমাবস্যার সময় যার জন্য এটির নাম "মাতা তীর্থে অনুসি "। "মাতা" মানে মা, "তীর্থ" মানে তীর্থযাত্রা। উত্সবটিতে মৃত মায়েদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় এবং জীবিত মায়েদের উপহার দেওয়া ও সম্মান জানানো হয়। কাঠমান্ডু উপত্যকার পূর্বদিকে অবস্থিত মাতা তীর্থে যাওয়া এই উত্সবের একটি অঙ্গ। এই তীর্থযাত্রাটি ঘিরে একটি কিংবদন্তি আছে। প্রাচীন কালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মা দেবকী ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। তিনি বহু জায়গা ঘুরে বাড়ি ফিরতে ভীষণ দেরী করেন.ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মায়ের অবর্তমানে খুবিই দুঃখিত হয়ে ওঠেন। উনি তখন মা কে খুঁজতে বেরিয়ে অনেক জায়গায় খোঁজেন কিন্তু খুঁজে পান না। শেষে যখন তিনি "মাতা তীর্থ কুন্ড"- তে পৌঁছন তখন তিনি মা কে দেখতে পান পুকুরে স্নানরত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আনন্দিত হয়ে ওঠেন মা কে খুঁজে পেয়ে এবং মা কে তিনি মায়ের অবর্তমানকালীন সব দুঃখের কথা বলেন। মা দেবকী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে বলেন "আহা! তাহলে এই স্থানটিকে আজ থেকে প্রত্যেক সন্তানের তাদের ছেড়ে আসা মায়েদের সঙ্গে মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠুক"। সেই থেকে এই জায়গাটি মৃত মায়ের সঙ্গে সাক্ষাত প্রাপ্তির এক দ্রষ্টব্য ও পবিত্র তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে। এও কিংবদন্তি আছে যে এক পুন্যার্থী পুকুরের জলে নিজের মায়ের প্রতিকৃতি দেখে প্রায় জলে পরে মারাই যাছিলেন। এখনও সেখনে পুকুর ধারটিতে লোহার বেঁড়া দেওয়া আছে। পুজার্চনার পরে পুন্যার্থীরা সেখনে নৃত্য, গানের মাধ্যমে নিজেদের মনোরঞ্জন করে। কিংবদন্তিগুলোর সত্যতা যাচাই করে দেখার অবকাশ নেই যেহেতু এগুলো প্রাচীন পুঁথির অনুযায়ী লোকমুখে চলে আসা সব ঘটনা সব। থাইল্যান্ড থাইল্যান্ডে মা দিবস পালিত হয় থাইল্যান্ডের রানীর জন্মদিনে। রোমানিয়া রোমানিয়া-তে দুধরনের আলাদা ছুটির দিন আছে: মা দিবস আর মহিলা দিবস। ইউনাইটেড কিংডম এবং আয়ারল্যান্ড মূল নিবন্ধ: Mothering Sunday ইউনাইটেড কিংডম ও আয়ারল্যান্ড-এ , ইস্টের সানডে(২৭শে মার্চ, ২০০৯)-র ঠিক তিন সপ্তাহ আগে, লেন্ট-এর চতুর্থ রবিবার মাদারিং সানডে পালিত হয়.খুব সম্ভবত ষোড়শ শতকের বছরে একবার নিজের মাদার চার্চ বা প্রধান গির্জায় যাওয়ার খ্রিস্টীয় রেওয়াজ থেকেই এর উত্পত্তি. এর মূল তাত্পর্য হল যে মায়েরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে মিলিত হবেন.অনেক ঐতিহাসিক -এর মতে যুবতী শিক্ষানবিশ-দের এবং অন্য যুবতীদের তাদের মালিকরা কাজ থেকে অব্যহতি দিত তাদের পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য[। ধর্মনিরিপেক্ষিকরণের ফলে এখন এই দিনটি মূলত মায়ের প্রতি সম্মান জানানোর দিন যদিও বহু গির্জা এটিকে এখনও সেই ঐত্তিহাসিক ভাবে দেখতেই পছন্দ করে যেখানে থাকে যিশু খ্রিস্ট -এর মা মেরি ও "মাদার চার্চ"-এর মত ঐতিহ্যবাহী রীতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। মাদারিং সানডে সর্বাগ্রে পড়তে পারে ১লা মার্চ(যে বছরগুলিতে ইস্টের পরে ২২শে মার্চ) ও তারপর পড়তে পারে ৪ঠা এপ্রিল(যখন ইস্টের ২৫শে এপ্রিল পরে)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র / কানাডা মূল নিবন্ধ: Mother's Day (North America) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মে মাসের ২ তারিখে মা দিবস পালন করে। ভিয়েতনাম ভিয়েতনামে মা দিবসকে বলা হয় লে ভূ-লান এবং চান্দ্র পঞ্জিকা অনুযায়ী সপ্তম মাসের পঞ্চদশ (পনেরো) দিনে এটি পালিত হয়। যাদের মায়েরা জীবিত তারা ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানায় আর যাদের মায়েরা পরলোক গমন করেছেন তারা প্রার্থনা করে মৃত মায়েদের আত্মার শান্তি কামনা করে। সরকারী মা দিবস পালনের ন' বছরের মাথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দিনটি এতটাই বাণিজ্যিক হয়ে পরে যে আনা জার্ভিস নিজেই এই তাত্পর্য পাল্টে যাওয়া দিনটির ঘোর বিরোধী হয়ে যান এবং নিজের সমস্ত সম্পত্তি ও জীবন দিনটির এইরকম অবমাননার প্রতিবাদে ব্যয় করেন[। মা দিবসের উদ্দ্যেশ: --------------------- আমরা যান্ত্রিক সমাজে দিন দিন আবেগহীন হয়ে পড়ছি। মায়ের আদর মমতা ভালবাসার কথা ভুলে যাচ্ছি। মায়ের মূল্যায়ন ভুলে যাচ্ছি। এই মায়ের গুরুত্ব মনে করিয়ে দিতেই এই দিবস। বানিজ্যকরন: --------------------- মা দিবসের বানিজ্যিকরন ও দিনটিকে বানিজ্যিক স্বার্থে কাজে লাগানোর প্রতিবাদে আনা তার সময়ে বহু সমালোচনা করেন। তিনি সমালোচনা করেন হাতে লেখা চিঠি না দিয়ে কার্ড কেনার নতুন প্রথাকে যেটিকে তিনি আলসেমি হিসাবে গন্য করতেন। ১৯৪৮ সালে আনাকে গ্রেপ্তার করা হয় মা দিবসের বানিজ্যিকরণের প্রতিবাদ করা কালীন এবং অবশেষে বলেন যে তিনি "ভাবেন যে এই দিনটির সূচনা না করলেই ভালো হত কারণ এটি এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনের বাইরে..." মা দিবস এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্যিকভাবে সবথেকে সফলতম পরব. ন্যাশেনাল রেস্টুরেন্ট অ্যাসোশিয়েশনের মতে রেস্টুরেন্টে ডিনার করার অন্যতম জনপ্রিয় দিন হল মা দিবস। উদাহরণ স্বরূপ দেখা যেতে পারে যে, IBISworld, একটি বানিজ্যিক পত্রিকার প্রকাশকের মতে, আমেরিকানরা আনুমানিক ২০৬ বিলিয়ন ডলার খরচা করে ফুলের ওপর, ১.৫৩ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন বিলাসী উপহারের ওপর - যেমন স্পা ট্রিটমেন্ট - এবং আরো 68 মিলিয়ন ডলার গ্রিটিংস কার্ডের ওপর। মাদার'স রিংস বা মায়েদের জন্য আংটির মত প্রচলিত উপহার নিয়ে, মা দিবস, মার্কিন গয়না শিল্পের বার্ষিক রাজস্বের ৭.৮ % রাজস্ব উত্পাদন করবে ২০০৮-এ। ফুল এবং অনান্য বানিজ্যিক শিল্পের লাগাতার প্রচার ও সহায়তা ছাড়া মা দিবস হয়ত আসতে আসতে উঠেই যেত। শিশুদিবস বা টেমপারেন্স সানডে -র মত অন্য প্রটেস্টান্ট ছুটির দিনগুলির এরম একই পর্যায়ের জনপ্রিয়তা নেই। তথ্য সূত্র - উইকিপিডিয়া ══════════════════════════════════════════════ লিখেছেন : খালেদ সাইফুল্লাহ রাজ

মা সাধারণ মানুষ

আক্কাছ সাহেব খুব সূক্ষভাবে ক্যালেন্ডার পর্যবেক্ষন করছেন। একেবারে খুটায়ে খুটায়ে দেখা যাকে বলে। ছুটির দিনের খোঁজে তিনি প্রায় এই কাজ করে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ দিনই ছুটি থাকেনা। ঠিক এ অবস্থায় তার বউয়ের অনুপ্রবেশ --- - তুমি কী জান কাল না মা দিবস? - তাই!!! কাল কী সরকারি ছুটি? - আরে ধূর!!! মা দিবসে ছুটি থাকবে কেন? - ও!!! তো কী হইছে? - না, আমার একটা শাড়ি কেনা লাগবে আর কিছু টাকা লাগবে মায়ের জন্য গিফট কেনার - ( ওরে হয়িন্নি, মা তোর, আর ট্যাকার বেলাই এই আক্কাছ? ) তো তোমার মা, তুমি দাও, আমাকে আবার টানার দরকার কী? আর তুমি নিজে থেকে দিলে উনি আরও বেশি খুশি হবেন, তাই না!!! - তার মানে!!! আমার মা তোমার মা না??? আর মাকে কী আমি তোমার কথা বলব? আমি তো বলব আমি দিচ্ছি। - (ওরে হয়িন্নি, দিমু আমি আর নাম নিবা তুমি) আচ্ছা ঠিকাছে। ঠিক তখনই আক্কাছের মনে পড়ল মা দিবসের কথা, প্রতি জন্মদিনের আক্কাছ বহুজনের কাছে গিফট পেত কিন্তু ওর মা ওকে দিত স্পেশাল কিছু যার জন্য ও সারাবছর অপেক্ষা করত। কিন্তু ও সেভাবে কিছুই দিতে পারেনি। বিয়ের পর বউকে শত শত গিফট দিলেউ মা কে যে কিছুই দেওয়া হয়নি। তো আক্কাছ সাহেব ভাবতে থাকে কী দেওয়া যায়, কী দেওয়া যায়.... (একখান টিভি দেই, নাহ!!! মেলা দাম, ১৫ হাজারের তলে নাই, তাও আম্মার আবার চোখে সমস্যা, বড় টিভি লাগব, থাক আর টিভি দিমু না, তাহলে কী দিমু, পাইছি একখান পুতুল... নাহ!!! আম্মা পুতুল লইয়া কী করব, ইশ!!! একখান আইডিয়া যদি বাড়াইত, হুম..... ইয়েস, পাইসি, আম্মারে কেক রাইন্ধা খাওয়ায়, ছুডুবেলায় আম্মা কইছিল, " আক্কাইচ্ছা, তুই আর যাই পারস, রাঁধতে পারবি না। " আইজ আম্মারে চমকাইয়া দিমুই দিমু।) তো যেই ভাবা সেই কাজ, খুব কষ্টে আক্কাছ সাহেব একটা রান্নার বই বের করল আর ওটা পড়ে কাজ করতে থাকল। তো বই অনুযায়ী আক্কাছ সাহেব ঠিক করল কেক বানানোই সোজা, সুতরাং সে কেকই বানাবে, বই পড়ে বিষয়বস্তু ভালোমতো বুঝে নিয়ে আক্কাছ সাহেব শুরু করল, প্রথমে একটা বাটিতে তেল, ময়দা, ডিম, পানি মিক্স করতে শুরু করল আক্কাছ সাহেব। কিন্তু কিছুতেই যেন হয়ে উঠেনা, তবে সারা গায়ে একটু ময়দা, ডিম লেগে আছেই, এ অবস্থায় বেল বাজল, আক্কাছ সাহেব গেলেন দরজা খুলতে....... - কিরে, আক্কাইচ্ছা, কী হাল করছস নিজের? - না, মানে... - বাড়িত বউমা নাই? - না, একটু বাপের বাড়ি গেছে। - ও, তা তুই রান্না করতাছস কার লাইগা? - তুমার লাইগা, - ক্যা? - ওমা!!! তুমি জাননা আইজ মা দিবস ------------------------ বাকী টুকু আক্কাছ ও তার মায়ের ভালোবাসা। এভাবেই শতশত আক্কাছ তার মাকে মা দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। আমিও বলি.... শুভ মা দিবস

মা মা মা

মা ফোন করে বললেন- কি রে তুই নাকি ওই মাইয়ারে এখনও পছন্দ করস ? যদি উল্টা পাল্টা কিছু শুনছি, তোর ঠ্যাঙ ভাইঙ্গা ঘরে বসায়া খাওয়ামু !
মা এরকম অনেক কিছুতেই আমার ঠ্যাঙ ভাঙেন। অনেক কিছুতেই ভয়ানক রেগে যান। সে শুধু ফোনে। বাস্তবিক ঠ্যাঙ ভাঙ্গাটা তাঁর কোনদিন হয়ে উঠে না। একটু আর্দ্র কণ্ঠে ডাক দিলেই ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন- কি হইছে বাবা ?
ঠ্যাঙ ভেঙ্গেছিলাম - আমি নিজেই। অনভ্যস্ত হাতে মোটর বাইক চালাতে গিয়ে - ধপাস! পড়ে যাবার ঠিক এক মিনিটের মাঝেই মা’র ফোন। বাবা , তুই ঠিক আছিস তো ? কী অবাক বিস্ময় ! সন্তানের বিপদের খবর মায়ের কাছে এতো দ্রুত পৌঁছায় কি করে ? সেদিন বুঝেছিলাম - সন্তান এবং মায়ের মাঝে অদ্ভুত এক নেটওয়ার্ক কাজ করে । একে কি টেলিপ্যাথি বলা হয় ? নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু ?
ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। চোখে জল এসে গিয়েছিল। ব্যথায় নয়। পৃথিবীতে অনেকের মা নেই। আমার মা আছেন। সেই অদ্ভুত অসঙ্গায়িত আনন্দে! আমার মা আছেন – এর চেয়ে উল্লসিত হবার মত বিষয় আর কি কিছু হতে পারে ?
আপন ভুবনে পরবাস- আমার হয়েছে এই দশা। মা গ্রামে থাকেন , আমি ঢাকায় থাকি। কাজের চাপে বাড়ীতে খুব কম যাওয়া হয় । মা কিছুক্ষণ পরপর ফোন করতেই থাকেন। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যাই। বলি – মা, এতো ফোন কর কেন? আমি কি ছোট বাচ্চাটি আছি , হারিয়ে যাব? মা হাসেন। বলেন – সময় হইলেই বুঝবি।
আমি জানি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করার কোনই কারন নেই। আমি জানি,মা শুধুমাত্র আমার কণ্ঠস্বর শুনতে চান, আমাকে উপলব্ধি করতে চান।
মা ! তুমি কথায় কথায় আমার ঠ্যাঙ ভাঙ্গতে চাও! কিন্তু আমি জানি- আমার ঠ্যাঙ দুটোকে দৃপ্ত পদক্ষপে সামনে এগিয়ে যাবার পথে যারা শুভাকাঙ্ক্ষী – তুমি অবধারিত ভাবেই তাঁদের দলপ্রধান।
বেশ কিছুদিন মাকে দেখিনা। আজ বিশ্ব মা দিবস।
মাগো ! বড় বেশি মিস করি তোমাকে ! খুব ভালোবাসি,খুউব,খুউব...... 

শুভেচ্ছা

সকল মা-কে 'মা' ব্লগ থেকে  'মা' দিবসের শুভেচ্ছা।
মা তোমায় ভালবাসি।
তোমার জন্য নিরন্তর শ্রদ্ধা।