(১)
গ্রামের নাম অর্জুনতলা। নাম শুনলেই অনেকের মনে হতে থাকবে,বিরাট কোন অর্জুন গাছের ছায়ায় বুঝি গড়ে উঠেছে এ গ্রাম!
যদিও আমি আজ পর্যন্ত অমন দৈত্যাকৃতির কোন অর্জুন গাছ দেখিনি। থাকলে,আমার চোখে তো পড়তই। এ গ্রামের সবকিছু যে আমার নখদর্পণে!
"কী ভাবছিস অত? চাচীর কথা?"
রানা ভাইয়ের প্রশ্নে,ভাবনায় ছেদ পড়ে আমার। নতুন ভাবনায় পড়ি। লুঙ্গির কোঁচড়ে ঝোলানো আমগুলোর স্পর্শ নিই একবার। এগুলো কিছুক্ষণ আগে,মাত্র চুরি করা। ওপাড়ার বদি চেয়ারম্যানের আমবাগান সাফ করে এসেছি একদম। ব্যাটা বহুত বজ্জাত। শান্তিকমিটির নতুন সদস্য। প্রচুর ভাব নিয়ে চলাফেরা করে। সুযোগ পেলেই থুতনীর ফিনফিনে কয়েকগাছি দাড়ি মুঠো করে ধরে। বিড়বিড় করে বলে,
"জান থাকতে,পেয়ারের পাকিস্তান মালাউনদের হাতে যাবেনা।"
"কীরে,চুপ মেরে আছিস যে?"
এবার সফিক জানতে চায়। আমি উদাস কন্ঠে বলি,
"রাতের অভিযান তো শেষ। এবার জননী সামাল দেয়ার অভিযানে নামতে হবে!"
(২)
"বাবু... এই বাবু... উঠে যা। আর কত ঘুমোবি? বেলা কতটা হয়েছে,সে খেয়াল আছে? বাবু?"
আমি কানে বালিশ চাপা দিলাম। প্রতি ভোরে এই একই দৃশ্য। মাকে বোঝাতেও পারিনা,ইনসোমনিক বলে সারারাত গ্রাম পাহারায় (!) কাটে আমার। ঘুমাই ভোরের দিকে। তাই সকাল আটটা ও আমার কাছে ভোররাত। আর ভোররাতে ওঠার মত যথেষ্ট বয়স্ক আমি নই। কিন্তু কে বোঝাবে এসব? স্বেচ্ছাসেবীর বড় অভাব এখানে।
"উফ! চুপ থাকো। আমার সময় হলে,আমি নিজেই উঠব। তোমাকে ভাবতে হবেনা।"
খেঁকিয়ে উঠি। তারপর আবার তলিয়ে যাই গভীর ঘুমে। মাঝে মাঝে ক্লাসগুলোও মিস হয়ে যায়,এই নেশাতুর ঘুমের ফলে! আর মায়ের হাহাকার শুনি তখন।
"বাবু নামটা রেখে ভুলই করেছি। এতবড় হয়েছে। তবু কিচ্ছু ঠিকভাবে হয়না,এই ছেলের দ্বারা! কিচ্ছু না!!!"
আর আমি বিরক্তিতে বিড়বিড় করি,
"কে রাখতে বলছে,এই নাম?"
এরপর জোরে রেডিও ছেড়ে দিই। দেশের হালচালে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করি। যাতে মায়ের হাহাকার আর না শুনতে পাই। কিন্তু বিধি বাম। রেডিওর সাথে পাল্লা দিয়ে,মায়ের কন্ঠের তীব্রতা বেড়ে যায়।
"নাওয়া-খাওয়া ফেলে এখন রেডিও? ঐ বন্ধ কর বলছি! বাবু...."
দু'হাতে কান চেপে ধরি। কত মেনে নেয়া যায়?
"বাবু,এটা করিসনে।"
"বাবু,ওসব খাসনে।"
"ঠান্ডা লাগবে।" "ওটা কর।" "এখন ঘুমা।" "উঠে পড়,আর কত?"
প্রায় সারাদিন মায়ের সতর্কবাণী,খবরদারী। মাঝে মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। চেঁচিয়ে জানতে চাই,
"পেয়েছ কী আমাকে,হুঁ? বড় হতে দেবে না? নিজে সব শিখে উঠতে দেবে না? আর এত্ত জানো কেনো তুমি? একটু কম কম জানলে কী হয়,শুনি?"
আমার সবজান্তা মা তখন কিচ্ছু বলেনা। মুখ টিপে,হাসে শুধু। যে হাসিতে পৃথিবীর সমস্ত মায়া জড়িয়ে আছে। বহু কষ্টে চোখ ফিরিয়ে নিই। ক্ষোভের অবশিষ্টাংশ বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। বিড়বিড় করে নিজেকেই শোনাই,
"ভদ্রমহিলা দেখি মায়া লাগানোটাও ভালভাবেই শিখেছে! হুহ..."
এই হল আমার মা! সাধু ভাষায়,"জননী"। যাঁর আচরণে মাঝে মাঝে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। মনে হতে থাকে-আমি বুঝি শুধু নামে নই ,আকৃতি এবং বয়সে ও বাবু রয়ে গেছি!
(৩)
"বাবু... যাসনে সোনামানিক আমার। যাসনে,বাবা। তোর মা যে বড্ড একা রে..."
আমি দৌড়াচ্ছি। প্রাণপনে দৌড়াচ্ছি। মায়ের হাহাকার অগ্রাহ্য করে। মাকে ফাঁকি দিয়ে। দেশের যা অবস্থা। আমি কী করে ঘরে থাকি? কিন্তু আমার সবজান্তা মা সেটা বুঝবেননা। বুঝতে চাইবেন না,বাবার হত্যাকারীদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখতে আমার কেমন লাগে!তাইতো মাকে ফাঁকি দিয়েছি। বলেছি, "আলুভর্তা,ডাল আর ঘিয়ে ভাজা পোড়া মরিচ দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।"
আর তিনি রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকতেই আমি পালিয়েছি। একছুটে পৌছে গেছি,রানা ভাইদের কাছে। রানা ভাইরা কয়েকজন আজ বর্ডার পেরিয়ে ইন্ডিয়া যাবেন। ওখানে নাকি গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ফায়ারিং শেখানো হবে। আমি অতকিছু বুঝিনা। শুধু বুঝি, শত্রুদের দিন ফুরিয়ে আসছে। আমার বাবার মত হাজারো বাবার মৃত্যুর মাশুল এবার গুণতে হবে তাদের। পকেট থেকে মায়ের ছবি বের করে বিড়বিড় করলাম,
"এই একটাবার তোমার বাবুকে বড় হতে দাও,মা। কথা দিচ্ছি,ফিরে আসব। তারপর যত খুশী,খবরদারি করো।"
(৪)
"পরবর্তী দুই সপ্তাহের বেশী কেটে গেল,ট্রেনিংয়ে। গোলাগুলির শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সব বাছাইয়ে ভালভাবেই উতরে যেতে পেরেছিলাম। অস্ত্র হাতে নিতে অস্বস্তি লাগত প্রথম প্রথম। এখন চাপা উত্তেজণা কাজ করে। মনে হয়, পেরে যাব।
মানিয়ে নিতে পেরেছিলাম আসলে। ওখানে খাবার দুইবেলা। তাও খুব সাধারণ। মাঝে মাঝে তো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তবু আমি সন্তুষ্ট। শক্ত মেঝেতে শুকনো পাতা কিংবা খড়ের বিছানায় ঘুমোতে,একদমই খারাপ লাগেনা। সিদ্ধান্ত অটল আমার। তাতে ফাটল ধরেনি। শুধু রাতে বিরেতে,ঘুমের মাঝেও তোমার স্পর্শ পেতে আকুলি বিকুলি করত মন। আর যখন তখন স্বপ্নে হানা দিতে তুমি। করুণ স্বরে বলতে, "বাবু,তুই কবে ফিরবি? ভাত তো জুড়িয়ে গেলোরে! পোড়া মরিচ নেতিয়ে গেছে। আলুভর্তা-ডাল বাসি। তুই ফিরবিনারে,বাবু? তোর মা যে বড্ড একা!"
লাফ দিয়ে উঠে বসতাম।বাকী রাত নির্ঘুম কেটে যেত। ভ্রম হত মাঝে মাঝে। মনে হত,একটু ভালভাবে শ্বাস নিলেই তোমার গন্ধ পাবো...."
থামলাম। স্মৃতি হাতড়াচ্ছি। মাকে বলার মত গল্প খুঁজছি,মনের এপাশ ওপাশ হাতড়ে।
"জানো মা,দেশে ফেরার পর তোমার সাথে দেখা করার কোন সুযোগই পাইনি। আমরা ঘাঁটি গেড়েছিলাম,এখান থেকে বহুদূরে। তবে মনের মাঝে জেদ চেপে গিয়েছিল আমার,তোমার সাথে দেখা করবই। একদিন কাউকে না জানিয়ে,পথ ধরলাম আমাদের গ্রামের। বাড়ির কাছাকাছি আসামাত্রই ধরা পড়ে গেলাম।
বদিউল চেয়ারম্যানের কথা মনে আছে,তোমার? বদি রাজাকার নামে চিনত লোকে। ঐযে বাবাকে একরাতে ডেকে নিয়ে গেল,বাড়ি থেকে? চারদিন পরে নদীতে ভেসে উঠল বাবার লাশ। আমার নীরিহ ভাল মানুষ বাবাটার চেহারা চেনার কোন উপায় ছিলনা সেদিন। পরনের ছিন্নভিন্ন কাপড় দেখে বুঝতে পেরেছিলাম,ওটা আমার বাবা। যে বেঁচে থাকলে হয়ত এখনও,আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোত। সে বাবা,যে আর কখনও রাজনীতি নিয়ে ছেলের সাথে আলোচনায় মেতে উঠবেনা! কথায় কথায় ছেলের সমর্থনে এগিয়ে আসবেনা।
বাবার হত্যাকারী সেই বদি রাজাকার। চিনে ফেলল আমাকে। ধরে নিয়ে গেল তার বাড়িতে। সেটা তখন পাক মিলিটারির অস্থায়ী ক্যাম্প।
সেখানে তার লোকেরা সারারাত মারল আমাকে। আঙ্গুলে এক এক করে পেরেক ঠুকল। আমি শুধু চেঁচিয়েছি। বারবার তোমাকে ডেকেছি গলা ফাটিয়ে। শেষরাতে বদি রাজাকার আমাকে দেখতে এসেছিল। গা জ্বালানো কথাবার্তা। অসহ্য হিংস্র হাসি। হঠাৎ কী ঘটে গেল আমার মাঝে,জানিনা! হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন হুঁশ হল,টের পেলাম আমি তাকে মেরে ফেলেছি। হ্যাঁ মা,তোমার কিচ্ছু না পারা বাবুটা সেদিন খালি হাতেই পিতৃহত্যার শোধ নিয়েছিল। পালালাম তারপর।
বাড়িতে এসে দেখি,তোমার অভিমান মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।.... ধরাছোঁয়ার বাইরে তুমি। বাবুর অপেক্ষা আর সইলনা,তাইনা?....................
জানো মা,এখনও চোখ বন্ধ করলে তোমার গন্ধ পাই। তোমাকে দেখি। তুমি আমার জন্য খাবার সাজিয়ে বসে আছ। অভিযোগের সুরে বলছ,
"বাবু এলি? ভাত তো জুড়িয়ে গেলোরে! খাবিনা?"
এখনও হাঁটতে গেলে,বাতাসে তোমার হাহাকার শুনি। ফিসফিসানো কাতরধ্বনি,
"বাবু যাসনে। তোর মা যে বড্ড একারে...."
তুমিতো সবজান্তা! এটা জানতেনা,তোমার বাবু ফিরে আসবে? এটা জানতেনা,তুমি চলে গেলে সে একা হয়ে যাবে?........................তোমার কিচ্ছু না পারা বাবুটা আসলেই খুব একা,মা। বড্ড বেশী একা!!!"
.........মা, তোর আঁচলে,
চেনা গন্ধে নাক ডুবাই..
বুঝাই নিজেকে,
আজ আমি অবাধে গাইতে পারি ,
বাংলার গান।
আজ আমি স্বর-ব্যঞ্জন বর্ণ সাজিয়ে,
একটা গল্প লিখতে পারি।
লাল সবুজের গল্প!
আজ আমি অবাক চোখে দেখতে পারি,
ষোড়শীর লাজুক মুখ।
প্রিয় বর্ণ সাজিয়ে,
সযত্নে বলতে পারি-
"ভালবাসি!!!".......
(৫)
মাঝবয়সী এক লোক ,মাটির ছোটখাট একটা ঢিবির উপর আছড়ে পড়ে কাঁদছে। তার কান্নায় অদম্য আকুলতা।আকাশে অনেক মেঘ। বাতাস থম মেরে আছে। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামল। এটা হয়তবা ঈশ্বরের কান্না। কিংবা কোন প্রিয় মানুষের। কেননা,এ কান্নায় ও আকুলতা আছে। কষ্ট ধুইয়ে দেয়ার,কিংবা লুকিয়ে রাখার আকুলতা। প্রকৃতি গোপনীয়তা বড় বেশী পছন্দ করে।