মা

মা
মা দিবসের শুভেচ্ছা

Thursday, May 15, 2014

আমার মা,আমার সবকিছু

স্নায়ু-চাপের খুব বড় ধরণের একটা অসুস্থতা দেখা দিয়েছিল একবার। তখন আমি সবে মাত্র প্রাইমারি থেকে হাই স্কুলে উঠেছি। সময়টাও বার্ষিক পরীক্ষার আগ দিয়ে। না স্নায়ু-চাপের কারণ পড়ালেখা কিংবা পরীক্ষার জন্যে নয়। কারণটা আমার পিতৃতুল্য কাউকে হারানো। খুব মনে আছে, আমি পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে খুব কষ্টে ঘাড়ের ব্যথা সহ্য করে বাড়ির সামনে পর্যন্ত পৌঁছেই "আম্মা" বলে চিৎকার দিয়েই জ্ঞান হারিয়েছিলাম। এরপর প্রায় ঘণ্টা ৩ আমার কোন ধরণের স্মৃতি নেই। ঘণ্টা তিন পর নিজেকে ঘরের খাটে আর আমার চারপাশ জুড়ে পুরো ঘর কানায় কানায় ভরা আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশী সমেত আবিষ্কার করি।
এর মধ্যেই আব্বা ঢাকা থেকে ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছেন (ঐ সময় মোবাইল ফোন ছিল না, আর যোগাযোগ একমাত্র ল্যান্ডফোন দিয়ে করতে হতো। সেটাও তখন আমাদের নেই। বাজারে থেকেই ঢাকায় অবস্থিত স্বল্পপরিচিত এক চাচাকে ফোন করে তাকে ডাক্তার নিয়ে আসার অনুরোধ করেন আব্বা)। ডাক্তার আমার পালস কিছুক্ষণ পরপর চেক করছে আর ফ্যাকাসে মুখ করে বার বার ঘড়ি দেখছে। জেগে উঠার মিনিট ১০ পার হবার আগেই আবার ব্যথা শুরু হয়, আর প্রায় সাথে সাথেই জ্ঞান হারাই ২য় বারের জন্যে। এর পর জ্ঞান ফিরে অনেক পরে, প্রায় এশার আজান হয়ে যাবার পর। এই সময়ের মাঝে ভিটামিন আর বিভিন্ন ঔষধ সহকারে স্যালাইন দেয়া হয় আমাকে। ঐদিন রাতে আর কোন সমস্যা হয়নি, সে যাত্রায় এতটুকুতেই পার পেয়েছিলাম।
এবার আম্মার কথায় আসি। আমি যখন দুপুরে "আম্মা" বলে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তার উপরই পড়ে যাই তখন বাড়িতে আম্মা আর দাদী ছাড়া কেউ ছিল না। চিৎকার শুনে আম্মাই দৌড়ে বেরিয়ে আসে আর রাস্তা থেকে ঘরে নিয়ে যায়। কেউ একজন আব্বাকে খবর দিতে বাজারে যায় আর আব্বা তখনই ডাক্তার আনার জন্যে চাচাকে ফোন করে বাসায় ফিরে আসে। ততক্ষণে আম্মা আমার মাথায় বালতি কয়েক পানি ঢেলে একাকার করে ফেলেছেন (ঐ সময় চাপকল দিয়ে পানি তুলে ব্যবহার করতে হতো)। তারপর তার কোলে আমার মাথা রেখে সেই যে বসেছেন তারপর একেবারে পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গার পর সেই বসা থেকে উঠেছেন।
এরপর কি করেছেন তার ছোট করে বলতে গেলেও অনেক বড় হয়ে যাবে। শুধু এতটুকু বলি, আম্মা এখনো যদি ভাত মাখিয়ে না দেয় তবে খেতে পারি না। এমন তো কিছু না সেই একই রান্না তবুও আম্মা যদি ভাত মাখিয়ে না দেয় তবে তা খেয়ে ঐ স্বাদ পাই না যেটা আম্মা মেখে দিলে পাই।
এখনো বাইরে কোথাও গেলে গড়ে ঘণ্টা খানিকের ভেতরে আম্মা একবার ফোন করেই। আর সেটা রিসিভ না করতে পারলে বাসায় আসলে ঝাড়ি এখনো শুনতে হয়। প্রতিটা প্রয়োজনের জিনিষ এখনো আম্মার কাছেই আবদার করি আর আম্মাও ছোটবেলার মত এখনো সেগুলি পূরণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। আমি সাধারণত কারো সাথে তর্ক করতে পারি না। তাই মাঝে মাঝে রাগ করে খাওয়া-দাওয়া কথা-বার্তা বন্ধ করে দেই। কিন্তু সেখানেও আম্মা হাজির। রাগটা যদি তার সাথেও করি বকা দিয়ে হোক আর রাগ ভাঙ্গানোর কথা দিয়েই হোক, আম্মাই সেটা করে।
জানিনা তার ত্যাগ আর ভালোবাসার ঋণী হয়ে কতটুকু কি করতে পারবো তার জন্যে, তবুও প্রার্থনা আল্লাহ যেন আমার দ্বারা কখনো তার মনে কোন কষ্ট না দেয়।
ভালো থাকুক আম্মা'রা, ভালোবাসায় থাকুক তাদের সন্তানেরা......

সবজান্তা মা এবং কিচ্ছু না পারা বাবু

(১) গ্রামের নাম অর্জুনতলা। নাম শুনলেই অনেকের মনে হতে থাকবে,বিরাট কোন অর্জুন গাছের ছায়ায় বুঝি গড়ে উঠেছে এ গ্রাম! যদিও আমি আজ পর্যন্ত অমন দৈত্যাকৃতির কোন অর্জুন গাছ দেখিনি। থাকলে,আমার চোখে তো পড়তই। এ গ্রামের সবকিছু যে আমার নখদর্পণে! "কী ভাবছিস অত? চাচীর কথা?" রানা ভাইয়ের প্রশ্নে,ভাবনায় ছেদ পড়ে আমার। নতুন ভাবনায় পড়ি। লুঙ্গির কোঁচড়ে ঝোলানো আমগুলোর স্পর্শ নিই একবার। এগুলো কিছুক্ষণ আগে,মাত্র চুরি করা। ওপাড়ার বদি চেয়ারম্যানের আমবাগান সাফ করে এসেছি একদম। ব্যাটা বহুত বজ্জাত। শান্তিকমিটির নতুন সদস্য। প্রচুর ভাব নিয়ে চলাফেরা করে। সুযোগ পেলেই থুতনীর ফিনফিনে কয়েকগাছি দাড়ি মুঠো করে ধরে। বিড়বিড় করে বলে, "জান থাকতে,পেয়ারের পাকিস্তান মালাউনদের হাতে যাবেনা।" "কীরে,চুপ মেরে আছিস যে?" এবার সফিক জানতে চায়। আমি উদাস কন্ঠে বলি, "রাতের অভিযান তো শেষ। এবার জননী সামাল দেয়ার অভিযানে নামতে হবে!" (২) "বাবু... এই বাবু... উঠে যা। আর কত ঘুমোবি? বেলা কতটা হয়েছে,সে খেয়াল আছে? বাবু?" আমি কানে বালিশ চাপা দিলাম। প্রতি ভোরে এই একই দৃশ্য। মাকে বোঝাতেও পারিনা,ইনসোমনিক বলে সারারাত গ্রাম পাহারায় (!) কাটে আমার। ঘুমাই ভোরের দিকে। তাই সকাল আটটা ও আমার কাছে ভোররাত। আর ভোররাতে ওঠার মত যথেষ্ট বয়স্ক আমি নই। কিন্তু কে বোঝাবে এসব? স্বেচ্ছাসেবীর বড় অভাব এখানে। "উফ! চুপ থাকো। আমার সময় হলে,আমি নিজেই উঠব। তোমাকে ভাবতে হবেনা।" খেঁকিয়ে উঠি। তারপর আবার তলিয়ে যাই গভীর ঘুমে। মাঝে মাঝে ক্লাসগুলোও মিস হয়ে যায়,এই নেশাতুর ঘুমের ফলে! আর মায়ের হাহাকার শুনি তখন। "বাবু নামটা রেখে ভুলই করেছি। এতবড় হয়েছে। তবু কিচ্ছু ঠিকভাবে হয়না,এই ছেলের দ্বারা! কিচ্ছু না!!!" আর আমি বিরক্তিতে বিড়বিড় করি, "কে রাখতে বলছে,এই নাম?" এরপর জোরে রেডিও ছেড়ে দিই। দেশের হালচালে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করি। যাতে মায়ের হাহাকার আর না শুনতে পাই। কিন্তু বিধি বাম। রেডিওর সাথে পাল্লা দিয়ে,মায়ের কন্ঠের তীব্রতা বেড়ে যায়। "নাওয়া-খাওয়া ফেলে এখন রেডিও? ঐ বন্ধ কর বলছি! বাবু...." দু'হাতে কান চেপে ধরি। কত মেনে নেয়া যায়? "বাবু,এটা করিসনে।" "বাবু,ওসব খাসনে।" "ঠান্ডা লাগবে।" "ওটা কর।" "এখন ঘুমা।" "উঠে পড়,আর কত?" প্রায় সারাদিন মায়ের সতর্কবাণী,খবরদারী। মাঝে মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। চেঁচিয়ে জানতে চাই, "পেয়েছ কী আমাকে,হুঁ? বড় হতে দেবে না? নিজে সব শিখে উঠতে দেবে না? আর এত্ত জানো কেনো তুমি? একটু কম কম জানলে কী হয়,শুনি?" আমার সবজান্তা মা তখন কিচ্ছু বলেনা। মুখ টিপে,হাসে শুধু। যে হাসিতে পৃথিবীর সমস্ত মায়া জড়িয়ে আছে। বহু কষ্টে চোখ ফিরিয়ে নিই। ক্ষোভের অবশিষ্টাংশ বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। বিড়বিড় করে নিজেকেই শোনাই, "ভদ্রমহিলা দেখি মায়া লাগানোটাও ভালভাবেই শিখেছে! হুহ..." এই হল আমার মা! সাধু ভাষায়,"জননী"। যাঁর আচরণে মাঝে মাঝে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। মনে হতে থাকে-আমি বুঝি শুধু নামে নই ,আকৃতি এবং বয়সে ও বাবু রয়ে গেছি! (৩) "বাবু... যাসনে সোনামানিক আমার। যাসনে,বাবা। তোর মা যে বড্ড একা রে..." আমি দৌড়াচ্ছি। প্রাণপনে দৌড়াচ্ছি। মায়ের হাহাকার অগ্রাহ্য করে। মাকে ফাঁকি দিয়ে। দেশের যা অবস্থা। আমি কী করে ঘরে থাকি? কিন্তু আমার সবজান্তা মা সেটা বুঝবেননা। বুঝতে চাইবেন না,বাবার হত্যাকারীদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখতে আমার কেমন লাগে!তাইতো মাকে ফাঁকি দিয়েছি। বলেছি, "আলুভর্তা,ডাল আর ঘিয়ে ভাজা পোড়া মরিচ দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।" আর তিনি রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকতেই আমি পালিয়েছি। একছুটে পৌছে গেছি,রানা ভাইদের কাছে। রানা ভাইরা কয়েকজন আজ বর্ডার পেরিয়ে ইন্ডিয়া যাবেন। ওখানে নাকি গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ফায়ারিং শেখানো হবে। আমি অতকিছু বুঝিনা। শুধু বুঝি, শত্রুদের দিন ফুরিয়ে আসছে। আমার বাবার মত হাজারো বাবার মৃত্যুর মাশুল এবার গুণতে হবে তাদের। পকেট থেকে মায়ের ছবি বের করে বিড়বিড় করলাম, "এই একটাবার তোমার বাবুকে বড় হতে দাও,মা। কথা দিচ্ছি,ফিরে আসব। তারপর যত খুশী,খবরদারি করো।" (৪) "পরবর্তী দুই সপ্তাহের বেশী কেটে গেল,ট্রেনিংয়ে। গোলাগুলির শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সব বাছাইয়ে ভালভাবেই উতরে যেতে পেরেছিলাম। অস্ত্র হাতে নিতে অস্বস্তি লাগত প্রথম প্রথম। এখন চাপা উত্তেজণা কাজ করে। মনে হয়, পেরে যাব। মানিয়ে নিতে পেরেছিলাম আসলে। ওখানে খাবার দুইবেলা। তাও খুব সাধারণ। মাঝে মাঝে তো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তবু আমি সন্তুষ্ট। শক্ত মেঝেতে শুকনো পাতা কিংবা খড়ের বিছানায় ঘুমোতে,একদমই খারাপ লাগেনা। সিদ্ধান্ত অটল আমার। তাতে ফাটল ধরেনি। শুধু রাতে বিরেতে,ঘুমের মাঝেও তোমার স্পর্শ পেতে আকুলি বিকুলি করত মন। আর যখন তখন স্বপ্নে হানা দিতে তুমি। করুণ স্বরে বলতে, "বাবু,তুই কবে ফিরবি? ভাত তো জুড়িয়ে গেলোরে! পোড়া মরিচ নেতিয়ে গেছে। আলুভর্তা-ডাল বাসি। তুই ফিরবিনারে,বাবু? তোর মা যে বড্ড একা!" লাফ দিয়ে উঠে বসতাম।বাকী রাত নির্ঘুম কেটে যেত। ভ্রম হত মাঝে মাঝে। মনে হত,একটু ভালভাবে শ্বাস নিলেই তোমার গন্ধ পাবো...." থামলাম। স্মৃতি হাতড়াচ্ছি। মাকে বলার মত গল্প খুঁজছি,মনের এপাশ ওপাশ হাতড়ে। "জানো মা,দেশে ফেরার পর তোমার সাথে দেখা করার কোন সুযোগই পাইনি। আমরা ঘাঁটি গেড়েছিলাম,এখান থেকে বহুদূরে। তবে মনের মাঝে জেদ চেপে গিয়েছিল আমার,তোমার সাথে দেখা করবই। একদিন কাউকে না জানিয়ে,পথ ধরলাম আমাদের গ্রামের। বাড়ির কাছাকাছি আসামাত্রই ধরা পড়ে গেলাম। বদিউল চেয়ারম্যানের কথা মনে আছে,তোমার? বদি রাজাকার নামে চিনত লোকে। ঐযে বাবাকে একরাতে ডেকে নিয়ে গেল,বাড়ি থেকে? চারদিন পরে নদীতে ভেসে উঠল বাবার লাশ। আমার নীরিহ ভাল মানুষ বাবাটার চেহারা চেনার কোন উপায় ছিলনা সেদিন। পরনের ছিন্নভিন্ন কাপড় দেখে বুঝতে পেরেছিলাম,ওটা আমার বাবা। যে বেঁচে থাকলে হয়ত এখনও,আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোত। সে বাবা,যে আর কখনও রাজনীতি নিয়ে ছেলের সাথে আলোচনায় মেতে উঠবেনা! কথায় কথায় ছেলের সমর্থনে এগিয়ে আসবেনা। বাবার হত্যাকারী সেই বদি রাজাকার। চিনে ফেলল আমাকে। ধরে নিয়ে গেল তার বাড়িতে। সেটা তখন পাক মিলিটারির অস্থায়ী ক্যাম্প। সেখানে তার লোকেরা সারারাত মারল আমাকে। আঙ্গুলে এক এক করে পেরেক ঠুকল। আমি শুধু চেঁচিয়েছি। বারবার তোমাকে ডেকেছি গলা ফাটিয়ে। শেষরাতে বদি রাজাকার আমাকে দেখতে এসেছিল। গা জ্বালানো কথাবার্তা। অসহ্য হিংস্র হাসি। হঠাৎ কী ঘটে গেল আমার মাঝে,জানিনা! হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন হুঁশ হল,টের পেলাম আমি তাকে মেরে ফেলেছি। হ্যাঁ মা,তোমার কিচ্ছু না পারা বাবুটা সেদিন খালি হাতেই পিতৃহত্যার শোধ নিয়েছিল। পালালাম তারপর। বাড়িতে এসে দেখি,তোমার অভিমান মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।.... ধরাছোঁয়ার বাইরে তুমি। বাবুর অপেক্ষা আর সইলনা,তাইনা?.................... জানো মা,এখনও চোখ বন্ধ করলে তোমার গন্ধ পাই। তোমাকে দেখি। তুমি আমার জন্য খাবার সাজিয়ে বসে আছ। অভিযোগের সুরে বলছ, "বাবু এলি? ভাত তো জুড়িয়ে গেলোরে! খাবিনা?" এখনও হাঁটতে গেলে,বাতাসে তোমার হাহাকার শুনি। ফিসফিসানো কাতরধ্বনি, "বাবু যাসনে। তোর মা যে বড্ড একারে...." তুমিতো সবজান্তা! এটা জানতেনা,তোমার বাবু ফিরে আসবে? এটা জানতেনা,তুমি চলে গেলে সে একা হয়ে যাবে?........................তোমার কিচ্ছু না পারা বাবুটা আসলেই খুব একা,মা। বড্ড বেশী একা!!!" .........মা, তোর আঁচলে, চেনা গন্ধে নাক ডুবাই.. বুঝাই নিজেকে, আজ আমি অবাধে গাইতে পারি , বাংলার গান। আজ আমি স্বর-ব্যঞ্জন বর্ণ সাজিয়ে, একটা গল্প লিখতে পারি। লাল সবুজের গল্প! আজ আমি অবাক চোখে দেখতে পারি, ষোড়শীর লাজুক মুখ। প্রিয় বর্ণ সাজিয়ে, সযত্নে বলতে পারি- "ভালবাসি!!!"....... (৫) মাঝবয়সী এক লোক ,মাটির ছোটখাট একটা ঢিবির উপর আছড়ে পড়ে কাঁদছে। তার কান্নায় অদম্য আকুলতা।আকাশে অনেক মেঘ। বাতাস থম মেরে আছে। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামল। এটা হয়তবা ঈশ্বরের কান্না। কিংবা কোন প্রিয় মানুষের। কেননা,এ কান্নায় ও আকুলতা আছে। কষ্ট ধুইয়ে দেয়ার,কিংবা লুকিয়ে রাখার আকুলতা। প্রকৃতি গোপনীয়তা বড় বেশী পছন্দ করে।

মা আমার

বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয়। খাতায় কলমে একেবারে যাকে বলে রাশভারী আমার বাবা হচ্ছেন সেই ধরনের মানুষ। সেই ছোটবেলা থেকেই আমার সকল অযৌক্তিক দাবী দাওয়া,ন্যায় অন্যায় সকল আব্দারের একমাত্র আশ্রয়স্থল হচ্ছেন আমার মা। বাবা এবং আমার মাঝখানে মা বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করেন। আমি কখনো কিছু করতে হলে মায়ের কাছেই পরামর্শ চাই। তবে এ ব্যপারে আমি খুব সুবিধাবাদী। ভাল লাগলে মানি,নয়তো এ কান দিয়ে ঢুকাই অন্য কান দিয়ে বের করে দেই। মানে মোটকথা হচ্ছন মা সংসারের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে সকল দায়দায়িত্ব নিপুণভাবে সমাধা করছেন।

দশ মাস দশ দিন কথাটা খুব প্রবলভাবেই শোনা যায়,কিন্তু এর গভীরতাটা বুঝা যায়না। একজন মা তার সারাটা জীবনের সুখ বিসর্জন দিয়ে একটা প্রাণকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন,আদরে শাসনে তাকে বড় করেন। অথচ মায়ের কোন দায় পড়েনি সন্তানকে বড় করে তোলার। সেই ত্যাগের কথা,সেই কষ্টের কথা যখন একবাক্যেই শেষ করার চেষ্টা করি তখন নিজেকে হিপোক্রেট মনে হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে একটা সন্তান জন্ম দিতে একজন মায়ের ২০টি হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার সমপরিমাণ কষ্ট হয়। এটা অনুভব করাতো দূরের কথা কল্পনা করা ও দুঃসাহসের ব্যপার। সেই অবর্নণীয় ব্যথাকে মায়েরা অবলীলায় অগ্রাহ্য করেন। কতটুকু ঐশ্বরিক শক্তিপ্রাপ্ত হলে এরকম করা যায়। এত শুধু কষ্টের শুরু মাত্র। মায়েদের সারাটা জীবন সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতেই চলে যায়। ঘরে যখন চারটা পিঠা থাকে আর মানুষ থাকে পাঁচজন তখন মা হাসিমুখে বলবেন আমি পিঠা খাইনা,তোরা খা। 

ছোটবেলায় মায়ের শাড়ীর গন্ধ শুকে ঘুমাতে যেতাম। এখন অনেক বড় হয়ে গেছি,নিজে পথ চলতে শিখে গেছি,মায়ের আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু আজ ও যখন খুব মন খারাপ হয়,তখনতো মা ছাড়া আর কাউকে পাশে পাইনা। মা হলেন অব্যক্ত বেদনা ব্যক্ত করার জায়গা,গোপন দুঃখ নিঃসংকোচে বলার জায়গা।

আজকে মা দিবস। এটাতো শুধুই ফর্মালিটি,মায়ের ভালবাসা কি আর একদিনের হয়রে পাগলা। মায়ের ভালবাসা হচ্ছে চিরদিনের চিরকালের। মায়ের কাছ থেকে ভালবাসা শুধু আনাই হয়েছে,কখনো তা ফেরত দেওয়া হয়নি। কখনো বলা হয়নি মা তোমাকে অনেক ভালবাসি,কোনদিন বলা হবে কিনা তা ও জানিনা।

সবাইকে মা দিবসের শুভেচ্ছা। পৃথিবীর সব মায়েরা সুখী হোক,ভাল থাকুক মায়েরা

মায়ের জন্য যতো কিছু

আমি জহির । বাংলাদেশের স্বনামধন্য এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে আছি লেকচারার হিসেবে। আমার জীবনটা নিয়ে আমি অনেক স্বন্তুষ্ট। আমি আজ অনেক ভালো অবস্থায়। কিন্তু এখানে আসতে আমাকে যতটা না কষ্ট করতে হয়েছে তার চেয়ে হাজার গূন বেশি কষ্ট আমার মা করেছেন।

আজ থেকে আঠাশ বছর আগের কথা। রেহানা বেগমের কোল আলো করে আসে ছোট্ট ছেলে। ফুটফুটে ছেলে। অল্পশিক্ষিত মা জহির রায়হানের খুব ভক্ত ছিলেন। তাই ছেলের নাম দেয় জহির রায়হান। ছেলেটাকে পাশে শুইয়ে দিয়ে মা চিন্তায় পড়ে যান খুব।ছেলের জন্মদাতা যে এখনো বাংলা মদের দোকানে ফুর্তিতে আছে।

রেহানা বেগম ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করেন। নেশাগ্রস্থ পিতার সহচর্যে যেয়ে এই হিরার টুকরা ছেলেকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেয়া হবে। হলো ও তাই। নেশার জন্য বাবা ছেলেকে বিক্রির কথাও তুলে। আমার মা এসব শুনে সাথে সাথেই তার বাবার বাড়ি চলে যান আমাকে কোলে নিয়ে। ভেবেছিলেন হয়তো বা মাথা গোজার ঠাই হবে সেখানে।

তিন ভাই এর সংসারে আমার মা একমাত্র বোন। ছোট মামা ও বিয়ে করে ফেলেছিল। তিন ভাই এর জন্য তিনটি রুম ছাড়া আমার নানার বাড়িতে আর একটাও অতিরিক্ত রুম ও ছিল না। আর আমার মামিরা প্রায় সব কাজই নাকি আমার মা কে দিয়েই করাতো। আমার মা ও সব কাজ করতো। মামিদের কাপড় ধোয়া,মামাতো ভাই বোনদের খাওয়ার ব্যাবস্থা করা সব কিছু করতো।

কিন্ডারগার্টেন এর ছেলেদের দেখে আমার মা প্রায়ই ভাবতো তার ছেলে এরকম রঙ্গিন ড্রেস পরে স্কুলে যাবে। স্কুল গাড়ি এসে তার বাড়ির সামনে এসে বেল বাজাবে। মাথায় সিথি করে চুল আচড়িয়ে দিয়ে আমার টিফিন বক্স নিয়ে মা আমাকে এগিয়ে দিবে।

কিন্তু না!! আমার ভাগ্যে কিন্ডারগার্টেন জুটেনি। আমার মায়ের ইচ্ছেও পুরণ হয়নি। মায়ের অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ছয় বছর বয়সে আমাকে মাথার উপর হাত দিয়ে অপর পাশের কান ধরে ভর্তি হতে হয়েছে সরকারী স্কুলে। স্কুলের শিক্ষকরা আমার উপবৃত্তির ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রতি ছয় মাসে আমি তিনশো টাকা পেতাম। সেটা দিয়ে আমার খাতা কলম কিনে দিতো মা। ঠিক দুইশো পঁচানব্বই টাকা খরচ করতো মা। বাকি পাচ টাকা দিয়ে মা একটা ব্লাউজ কিনতো নিজের জন্য।

না,এভাবে বসিয়ে রেখে খাওয়াতে একেবারেই সমস্যা হচ্ছিল আমার মামা মামিদের। দুটো উটকো ঝামেলা এসে তাদের ঘাড়ে পড়বে তারা চিন্তাও করেনি কখনো। আমার মা কে বলা হলো পরের মাস থেকে বাড়ি থাকতে হলে খাওয়া থাকা বাবত টাকা দিতে হবে।উপায়ান্তর না পেয়ে আমার মা পাশের বাড়িতে কাজ করে। এক বাড়ির কাজ দিয়ে সংসার চলতো না।এক সময় আমার মা চারটা বাড়িতে বুয়ার কাজ করতো।

আমি এক ক্লাস দুই ক্লাস করে বড় হই। প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠার সময় আমি প্রথম হয়েছিলাম। মজার ব্যাপার হলো,যে ছেলেটি সেকেন্ড হয়েছে তাদের বাড়িতে আমার মা কাজ করতো। এবং টানা দুই ক্লাস আমি ফার্স্ট হবার কারণে আমার মায়ের চাকুরী যায় ও বাড়ি থেকে।

স্কুলের এক শিক্ষক আমার ভালো ফলাফল দেখে উনি আমাকে বিশ টাকা দিয়েছিলেন। সেদিন আমার খুব খুশি লেগেছিল। আমার মায়ের ছেড়া শাড়ি সেলাই করতে তিন টাকা, একটা সাবান কিনি সাত টাকায় আর বারো টাকা মা কে দিয়ে আসি।

আমার মা হণ্যে হয়ে খুঁজছিলেন একটা চাকরী। বুয়ার চাকরী। মা পেয়েও যায়। নিজের বাবার বাড়িতেই। আমার মেঝ মামার ঘরের সব কাজ করে দেন তিনি। আমার মামি আমার মা কে আর নাম ধরে ডাকেনা। 'বুয়া' বলে ডাকতো। একদিন আমি আমার মা কে জিগেস করি, 'মা, বুয়া মানে কি?' আমার মা হেসে উত্তর দেয়, 'বাবা, বুয়া মানে হলো যাদের তোর মতো একটা লক্ষী ছেলে আছে '।

কিন্তু না। আমি বুঝে যাই এটার মানেটা আমার মা আমাকে লুকিয়েছে। স্কুলে একটা ছেলের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিল। সে আমাকে বলেছিল,'তুই তো বুয়ার ছেলে '। আমি তাকে বললাম,'পারলে বুয়ার ছেলে হয়ে দেখা, আমার মা বলেছে যাদের আমার মতো একটা ভাল ছেলে আছে তাদের কে বুয়া বলা হয়।' ব্যাস মুহুর্তেই হাসির রোল পড়ে গেলো চারিদিকে। মা কে এসে কিচ্ছু বলিনি। শুধু জেনেছি এই শব্দটা খারাপ। শুধু বুঝেছি এটা আবার জিগেস করলে মা হয়তো রাগ করবে।

আমি প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে হাই স্কুলে উঠি। প্রাইমারি স্কুলে আমার বই ফ্রি তে দিতো সরকার। কিন্তু হাই স্কুলের বই নাকি কিনতে হয়।আমার মা আমার মামাকে বলেছিল। মামা আবেগী হয়ে পকেটে হাত দেয়ার সময়ই মামি এসে মামাকে টেনে রূমে নিয়ে যায়। ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয়। যেই সব বাড়িতে কাজ করতো তারাও কেউ দেয়নি টাকা। আমার মা গভীর চিন্তায় পড়ে যায়। পরের দিন সারাদিন মাকে আর দেখিনা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমার মা রাতে এসেছিল।দেখলাম তার হাতে ব্যান্ডেজ। আর হাতের মুঠোয় কিছু টাকা। কিছু বলিনি। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি মা আমার বই কেনার জন্য রক্ত বিক্রি করতো।

আমি পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পাই। সেখানের টাকা দিয়ে আমি নিজ হাতে মায়ের জন্য শাড়ি কিনি। আমার মা সে শাড়ি দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদে। আমি তখনো বুঝিনি মা কেন কাদছে। আশ্চর্যের ব্যাপার মা কে বাবার কথা বলতেই মা আমার উপর রাগ করতো। কখনোই কিছু বলতো না।

আমি অষ্টম শ্রেণী পাশ করার পর সবাই বলেছিল আমি যেন সাইন্স নিই। কিন্তু শুনেছি সাইন্সে নাকি অনেক খরচ। সব বিষয়ের প্রাইভেট পড়তে হয়। তখন আমার টাকা পয়সার বিষয়ে জ্ঞান বুদ্ধি হয়। আমি বুঝতে পারি আমার মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে। আমি তখন বুঝতে শিখেছি বুয়া মানে কি। ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানের প্রতি আমার ঝোক ছিল। বাশের ভেতর ব্যাটারি দিয়ে আমি টর্চ বানিয়ে একবার বিজ্ঞান মেলায় পুরষ্কার ও পাই। কিন্তু আমি সাইন্স নিতে পারিনি। আমি নিয়েছি কমার্স।কোন মতে আমার পড়াশোনা চলছে। ক্লাস নাইনে উঠেছি। এখন নিজের ও খরচ আছে। তাই আমি টিউশানি খুজি। একটা ক্লাস থ্রির ছেলেকে পড়ানো শুরু করি। আমার মা অনেক নিষেধ করেছিল কিন্তু আমি তো জানি হয়তোবা আমার খরচ জোগাড় করার জন্য আমার মা আরেক বাড়িতে কাজ নিবে।

এভাবে দিন যেতে পারতো। কিন্তু আমার তিন মামি কেন জানি আমার পড়ালেখা সহ্য করতে পারতো না। একদিন তো আমার বড় মামি কোন কারণ ছাড়া আমার হিসাববিজ্ঞান বই ছিড়ে ফেলে। সেদিন প্রথম আমার মা প্রতিবাদ করে।
তারপর থেকে আমার ছোট মামির ঘরে আমার মার চাকরী শেষ।

হিসাব বিজ্ঞান বই টা এমন দিনে ছিড়েছে পরের দিন আমার পরীক্ষা ছিল। মা বুঝতে পারে। কিন্তু মা এটা করবে আমি ভাবিনি। এক বাড়িতে ঘর ঝাড়ু দেয়ার সময় ত্রিশ টাকা চুরি করতে গিয়ে ধরা খায় আমার মা। সেদিন সেই বাড়ির চাকরীও যায়।

এবার মা কাথা সেলাই শুরু করে। এক মাসে একটা নকশী কাথা সেলাই করে দিতো মা । পাটি বানাতো। মোড়া বানাতো। এসব নিয়ে আবার হাট বারে বিক্রি করতো। আমার মা কখনো আমাকে বাজারে যেতে দেয়নি। অনেক বলতাম, 'মা তুমি বানাও আমি বিক্রি করবো। ' আমার মা বলতো,'না, এই বয়সে ছেলেরা বাজারে গেলে নষ্ট হয়ে যায়। ' আমিও চুপচাপ থাকতাম।

আমাদের ঘরটা ছিল ছোট্ট। একটা চৌকি আর সুপুরি গাছ দিয়ে বানানো একটা মাচা,যার উপর বই রেখে পড়াশোনা করতাম আমি।

আমার টিউশানির টাকা আর আমার মার কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে দিন চলে যায় আমাদের। কিন্তু বিনা দোষে আমার মামিরা আমার মার উপর অত্যাচার করত মানসিক ভাবে। একদিন মা বলেই দিলো,"এটা আমার বাবার বাড়ি। আমার সম্পত্তি বুঝিয়ে দেন"। তারপর থেকে মামিরা কথা বলতো না আর।

আমার নিজ মামাতো ভাই আমাকে 'বুয়ার ছেলে ' বলে ক্ষ্যাপাতো। একদিন আমি উত্তেজিত হয়ে তাকে থাপ্পড় দিই। সাথে সাথে আমার মামা বের হয়ে আমাকে প্রচন্ড আঘাত দেয়। আমার মা তখন অন্যের বাড়িতে কাজে ছিলেন। নইলে সেদিন অনেক বেশি কিছু হতো।

মেট্রিক পাশ করি আমি। বোর্ড স্ট্যান্ড হই। আমাদের দিন টা তখনই বদলে যায়। তিন চারটা টিউশানি পাই আমি। আমার মা কে বলি উনি যেন আর কারো বাসায় না যান। মাও আমার কথায় রাজী হয়ে অনেক বাড়িতেই কাজ ছেড়ে দেয়। শুধু একটা বাড়িতে কাজ রাখে। এটা নাকি উনার প্রিয় বাড়ি। কিন্তু একি? যার বাড়িতেই পড়াতে যাই সেই বলে,'আমার মা কি তাদের বাড়িতে কাজ করতে পারবে কিনা?' আমার বুক টা ফেটে যায় তখন। ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলি আমার মা বুয়া না।
বাধ্য হয়ে আমি পড়ানো ছেড়ে দিই। আবারো কষ্ট নামে আমাদের সংসারে।

গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে কিছু ছাত্র পাই আমি। প্রতিদিন হেটে হেটে গিয়ে আমি তাদের পড়াতাম। আমার মার একটাই স্বপ্ন তার ছেলে বড় হয়ে দেশের নামকরা একজন হবে। টিভির পর্দায় তাকে দেখবে দেশের লোকজন।

ইন্টার পরীক্ষা আমার মার সেই স্বপ্ন ভেঙে দেয়। অনেক দূরে প্রাইভেট পড়ানোর ফলে আমি অসুস্থ হয়ে যাই। পরীক্ষা দিতে পারিনি সেবার। আমার মা আমাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আর কোন টিউশানি নয়।যত টাকা লাগে আমি দিবো। '

আমার মা আবারো মানুষের বাড়িতে কাজ নেয়। পাটি বানায়। নকশী কাথা সেলাই করে। পুরো এক বছর আমার মা অনেক পরিশ্রম করে। পরের বছর ইন্টার পরীক্ষায় আমি ভালো ফলাফল করি। আশ্চর্য জনক ভাবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আই বি এ তে চান্স পাই।

আমাদের কষ্টের দিন শেষ। হলে উঠে আসি আমি। টানা ছয় মাস প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু টাকা জমিয়ে নিই আমি। এ ছয় মাস আমার মা বাড়িতে ছিল। মামিদের অত্যাচার সহ্য করে আর পাড়ার লোকের বাজে কথা শুনে। আমার মার নাকি ভাব বেড়ে গেছে। এখন আর কারো ঘরে কাজ করেনা। তার ছেলে যে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে!!

আমি মা কে নিয়ে আসি ঢাকাতে। বস্তি টাইপ একটা ঘর ভাড়া করি আমরা মা ছেলে। তখন জানতে পারি আমার বাবার কথা। এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। তাই মা আমাকে সব বলেছে। বাবার খোজে আমি বাড়ি যাই। শুনি আমার বাবা নাকি ড্রাগ কেনার জন্য নিজের কিডনী বিক্রি করেছিল। সেই ড্রাগ হাতে থাকা অবস্থায়ই বাবা মারা যায়।মা কে ঘটনা টা বলতেই আমার মা কেদে দেয়।হাজার হউক স্বামী তো।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় হই। প্রথম তিন জনের মা কে গোল্ড মেডেল দিবে। আমার মা কে আমি নিয়ে যাই। প্রাইভেট পড়িয়ে উপার্জিত টাকা দিয়ে মাকে কিনে দিই নতুন শাড়ি। সংসারে মোটামুটি অভাব নাই এখন।

গোল্ড মেডেল দেয়ার আগে প্রত্যেক মার বক্তব্য শোনানো হয়।আমার মার বক্তব্য শুনে আমাদের ভিসি কেদে দেয় আর প্রধান অতিথী প্রধানমন্ত্রী ও কেদে দিয়েছিলেন। তারা সবাই এতটাই আবেগাক্রান্ত হয়েছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী যাদের কে মেডেল পরিয়ে দেয়ার কথা সেই প্রধানমন্ত্রী আমার মা কে আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের তিন জনকে মেডেল পরিয়ে দেয়ার জন্য।

এরপর গত ছয় মাস আমি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি। লন্ডনের স্কলারশীপ পেয়েছি আমি। মা সহ যাবো তাই একটু দেরী করছি। ঢাকার বারিধারায় আমি একটা ফ্ল্যাট কিনি মায়ের জন্য। তিনটা কাজের লোক রেখেছি মায়ের সেবা করার জন্য। আশ্চর্যের ব্যাপার আমার মা তাদের কে কাজ না করিয়ে গল্প করে তাদের সাথে। মাকে জিগেস করতেই মা বলে,'আমিও তো এক সময় তাদের মতোই ছিলাম বাবা। '

আমি কিচ্ছু বলিনি। আমার মায়ের পরনে এখন আর ছেড়া শাড়ি নেই। নবরূপা থেকে কেনা শাড়ি আমার মায়ের পরনে। মা এখন আর মোটা চালের ভাত খায় না। আমি যে তার জন্য নাজির শাইল কিনি।
আমার মায়ের জন্যই তো এত দুর আসা আমার.....

Sunday, May 11, 2014

মা কে চিরবিদায় দেওয়ার দিনের ঝাপসা স্মৃতি



যাদের মা অনেক দূরে তারা যেমন তাদের মাকে মিস করে আমিও তেমনি খুব মিস করি আমার মাকে। কিন্তু তাদের এবং আমার মিস করার মধ্যে কোন মিল নেই। কারন, অনেকে হয়তো মায়ের কাছ থেকে সাময়িকভাবে দূরে আছে, হয়তো আবার ফিরে যাবেন মায়ের কোলে। কিন্তু আমার যে আর সেই সুযোগ নেই। আমি আমার সেই সাডে ছয় বছর বয়সে আমার প্রাণপ্রিয় মাকে চিরবিদায় দিয়েছি।
আমার ঠিক স্পষ্ট মনে নেই সেদিনকার কথা। ২০০৩ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর, আমার মা ছিলেন আমার নানার বাডিতে। সেখানেই আমার শেষ ভাইয়ের জন্ম হয়েছিল। বাডিতে ছিলাম আমি আর আমার বাবা। আমার বাবা প্রতিদিন চলে যেতেন হাই স্কুলে (তিনি সেখানকার শিক্ষক), যাবার পথে আমাকে আমার কেজি স্কুলে পৌছে দিতেন (তখন আমি নার্সারীতে পডি)।
২৯ তারিখও প্রতিদিনের মত স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাবার সাথে স্কুলে যাবার জন্য বের হয়েছিলাম। হঠাত্করে একটা মোটরসাইকেলে করে আমার মেজ মামা এবং আরেকজন লোক তাডাতাডি করে আমার বাডিতে আসল এবং আমার বাবাকে কি যেন বলল (আসলে তারা সেদিন আমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ দিতে এসেছিল)। তারপর আমার মামা আমার ব্যাগটা খুলে বাডির ভেতর ছুডে মারল আর বলল 'আজকে স্কুলে যেতে হবে না'। আমি তখন দারুণ খুশি হয়েছিলাম (তখনো আমি বুঝতে পারিনি আমার মা মারা গেছেন)।
তারপর আমার বাবা আমাকে পুকুরপাডে অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি আসার আগ পর্যন্ত আমি সেখানে অপেক্ষা করার সময় পাশের বাডির একটা মেয়ে বলল 'তোর মা মারা গেছে'। আমি প্রথমে ভাবলাম সে আমার সাথে ঠাট্টা করছে, কিন্তু পরে তার সিরিয়াস কন্ডিশন এবং আমার বাবার অবস্থা দেখে চিন্তা করলাম হতেও পারে।
আমার বাবা একটা বেবীট্যাক্সি নিলেন এবং বললেন 'চুনতি' যাবেন, তখন আমি আরো নিশ্চিত হলাম ('চুনতি' ইউনিয়নে আমার নানার বাডি)।
আমি স্কুলের ড্রেস পডা অবস্থায় গাডিতে ওঠে পডেছিলাম।
গাডিতে ওঠার পর দেখলাম আমার বাবা খুব কাঁদছেন আর ড্রাইভারকে তাডাতাডি গাডি চালাতে বলছেন (আমার বাডি থেকে নানার বাডির দুরত্ব প্রায় ছয় মাইল)।
সম্ভবত সকাল আটটার দিকে আমরা সেখানে পৌছেছিলাম। সেখানে পৌছার সাথে সাথে বেশ কয়েকজন আমাকে বারবার কোলে নিতে থাকল এবং তারা আমাকে জডিয়ে ধরে কাঁদছিল। পুরো বাডিতে লোকে গিজগিজ করছিল।
ভেতরে যাওয়ার পর আমার ভাই সজীব'কে দেখলাম, সে আমার মায়ের সাথেই নানার বাডীতে এসেছিল (সজীব আমার ছোট ভাই, তখন তার বয়স ছিল দুই বছর)। একজন আমাকে বলল আমার তৃতীয় আরেকটা ভাই হয়েছে।
আমার মামা আমাকে কোলে নিয়ে গিয়ে আমার মা কে দেখাল। দেখলাম মা শুয়ে আছেন এবং চারপাশের লোকজন তার দিকে তাকিয়ে কাঁদছেন। কয়েকজন আমাকে বলল 'তোর একটা ছোট ভাই হয়েছে তো তাই তোর মা ঘুমিয়ে আছেন'। এই কথাটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি....
পরে যখন বুঝতে পারলাম মা মারা গেছেন তখন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
সবাই বলাবলি করছিল 'ডেলিভারীর সময় মারা গেছেন'। সে সময় আমি এই কথাটির মানে বুঝতেই পারিনি।
অনেক্ষন পর দেখলাম আমার মাকে খাটিয়ায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানতে পারলাম তাকে কবর দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি তখন ছোট থাকায় আমাকে নেওয়া হয়নি। তারপর আমি আর আমার বাবা ওই দিন জন্ম নেওয়া ভাইটাকে নিয়ে চলে এসেছিলাম। দুই বছর বয়সী যেই ভাই টা আমার
মায়ের সাথে নানার বাডিতে গিয়েছিল, সে ওখানেই ছিল।
এর অনেক বছর পরে আমি জানতে পারি যে আমার সর্বকনিষ্ঠ ভাইয়ের জন্ম দেওয়ার সময় তিনি মারা গেছেন।
সন্তানের জন্য একজন মা কতবড সেক্রিফাইজ করতে পারেন তার জলন্ত উদাহরণ আমার 'মা'
আমি এবং আমার দুই ভাই গত বারোটি বছর কাটিয়েছি মাতৃহীন অবস্থায়। হয়তো ভবিষ্যতের দিনগুলোও এভাবেই কাটবে।
এখন সারাজীবন মাকে শুধু মিস করেই যাবো কিন্তু কোনদিন মাকে ফিরে পাবো না।
একটা বড রকমের আফসোস হয় আমার মায়ের কবর আমার নানার বাডীতে, তাই নিয়মিত কবর জিয়ারত করতে পারি না। তারপরেও আমি নামাযের পর সবসময় মায়ের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করি। আপনারাও আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন।

আমার মা ---
নামঃ মোবরেকা খানম সিদ্দিকা (রেখা)
জন্মঃ ৩০ জুন ১৯৭০
মৃত্যুঃ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৩


লিখেছেন- শাহরিয়ার 

মাকে খুঁজি আমি

আমি মাকে খুঁজি
আমার মা অসাধারণ এক রমণী,
সেই মাকে আমি হাঁরিয়ে খুঁজছি।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যেত আমার
চোখ খোলেই দেখতাম মা দাঁড়িয়ে,
এখনতো আর মাকে দেখতে পায়না
তবে মা কি আমার গেঁছে হারিয়ে ?
তোমরা কি আমার মাকে দেখেছ?
আমি যে তাঁকে খুঁজে পাইনা আর,
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি মায়ের হাসি !
চোখ মুছে দেখি এতো ভোরের সূর্য ,
দূরে উড়তে দেখি মায়ের শাড়ির আঁছল!
ভুল এতো ধাঁন ক্ষেতে বাতাসের দোলা।
হঠাৎ খুঁজে পাই মায়ের শীতল স্পর্শ!
না আবার ভুল এতো ভোরের শিশির।
হঠাৎ জেগে দেখি মায়ের কোলে ঘুমিয়ে আছি!
হ্যাঁ এইতো আমার মা আমি তাঁকেই খুঁজছি।
অনেক দিন পর আমি মাকে খুঁজে পেয়েছি!
আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি দেশমাতৃকার কোলে।

লিখেছেন- ইমরুল 

মা থাকুক মায়ের মতই পবিত্র

একটু উল্টাভাবে কিছু কথা বলি ... মা'কে ভালোবাসেনা এমন মানুষ মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবেনা কিন্তু যখনই কোনও বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু হয় দেখা যায় অন্যজনকে মা তুলে গালি দেয়া হয়। তখন অন্যজনও আপনার মা তুলে গালি দেয়।
অন্যজন কতটুকু কষ্ট পায় জানিনা তবে আপনি ঠিকই আপনার মা'কে গালি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে ফেলেন। আপনার কারনে , আপনার মা গালি খাচ্ছে ... চিন্তা করে দেখেন কেমন লাগে।
-রাজনীতি নিয়ে ঝগড়া লাগলে , মা'কে তুলে গালি দেয়া হয়
-খেলাধুলা নিয়ে ঝগড়া লাগলে , মা'কে তুলে গালি দেয়া হয়
-ধর্ম নিয়ে ঝগড়া লাগলে , মা'কে তুলে গালি দেয়া হয়
মা তুলে কেন গালি দেয়া হয় ... মা কি দোষ করল এইটা এখনো মাথায় ঢুকে নাই। পৃথিবীতে খারাপ মা বলে মনে হয় কিছু নেই ... মা'কে শুধু ভালোবাসা যায় ... গালি দেয়া যায় না।
কেউ একজন বলছিল,"আমি প্রথম দর্শনে ভালোবাসায় বিশ্বাসী, কারন পৃথিবীতে আসার পর চোখ খুলেই আমার মা'কে ভালোবেসেছি"

লিখেছেন- MOYLA BABA